পঁচাত্তর পেরিয়ে বিবিসি বাংলা এখন চলছে ডিজিটাল ভবিষ্যতের পথে

  • সাবির মুস্তাফা
  • সম্পাদক, বিবিসি বাংলা
ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিসান বেকারি

ছবির উৎস, AP

ছবির ক্যাপশান,

ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিসান বেকারি: আক্রমণের খবর প্রচারে ডিজিটাল মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

আমি যেদিন বিবিসিতে যোগ দেই, সেদিন ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা ভাবছিলাম না। সতেরো বছর পরেও যে বিবিসিতে রয়ে যাবো, সে তো দূরের কথা। কিন্তু শুধু যে রয়েই গেলাম তাই নয়, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অংশ হিসেবে বিবিসি বাংলা যে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, তাতে অংশ নিতে পেরেছি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পেরেছি।

সেদিন ছিল মার্চ মাসের ১৮ তারিখ। দু'দিন আগে লন্ডনে এসে পৌঁছেছি। ব্রিটেনের সাথে আমি আগেই পরিচিত ছিলাম - ১৯৭৬ সালে স্কুলে পড়তে আসি, রয়ে গিয়েছিলাম ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। তখন পড়া-শোনার কারণে এসেছিলাম বলে স্থায়ী বসবাসের কোন সুযোগ ছিলনা। এবারো স্থায়ী বসবাসের পরিকল্পনা করে আসিনি।

বিবিসি বাংলায় প্রযোজক হিসেবে চাকরীর জন্য যখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলাম তখন তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ মাহমুদ আলী এবং দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক স্যাম মিলার জানিয়ে দেন, যে চাকরীর মেয়াদ হবে তিন বছর এবং সেটা বাড়ানোর কোন সুযোগ থাকবে না (যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে দু'বছর বাড়ানো হতে পারে)। বিবিসি বাংলায় তখন (আমাকে সহ) ১৪জন পূর্ণকালীন কর্মীর মধ্যে মাত্র তিনজনের স্থায়ী চুক্তি ছিল।

বিবিসির তৎকালীন মহা পরিচালক জন বার্ট 'নতুন রক্তে' বিশ্বাসী ছিলেন - তিনি মনে করতেন বিবিসির মত একটি সৃজনশীল সংস্থাকে গতিশীল রাখতে নিয়মিত নতুন এবং তরুণ কর্মী নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সেটা করার জন্য অনেক নিয়োগ স্বল্পমেয়াদী করা হয়েছিল, যার ফলে অনেকের চাকরী জীবনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল।

মহা পরিচালক পদে তাঁর উত্তরসূরি গ্রেগ ডাইক ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের মানুষ। তিনি এই 'নতুন রক্ত' নীতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসেন ।

বছর তিনেকের মধ্যেই পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করলো। প্রথমে নতুন সব চাকরী স্থায়ী হিসেবে অফার করা হলো, যার জন্য স্বল্প মেয়াদের কর্মীদের আনুষ্ঠানিক আবেদন, পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয় (এভাবেই আমাকে ২০০০ সালে স্থায়ী ভিত্তিতে সিনিয়ার প্রযোজক পদে নিয়োগ করা হয়)।

কয়েক বছরের মধ্যেই বিবিসিতে স্বল্প মেয়াদের প্রকল্প বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যেসব পদ প্রয়োজন সেগুলো ছাড়া মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই স্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতেই নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। বিবিসি বাংলা যখন তার ৭৫ বছর পূর্তি উদযাপন করছে, তখন লন্ডন, ঢাকা, দিল্লি আর কলকাতায় মোট ২৬জন কর্মীর সকলেই স্থায়ী।

তবে চাকরী ক্ষেত্রের পরিবর্তন বিবিসির অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, শ্রোতাদের জন্য গুরুতপূর্ণ পরিবর্তনগুলো এসেছিল অনুষ্ঠানের ধরন, মেজাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিতে। এসব পরিবর্তনের জন্য সম্পাদকীয় বিবেচনা এবং শ্রোতাদের চাহিদার বিবর্তন যেমন বড় ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি করেছে প্রযুক্তি। (এই স্মরণিকার অন্যান্য পাতায় আমার সহকর্মী মানসী বড়ুয়া, মাসুদ খান এবং ওয়ালিউর রহমান আলোকপাত করেছেন কীভাবে বিবিসি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে)।

ছবির ক্যাপশান,

বিবিসি বাংলার জন্য রেডিও এখনো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এগিয়ে ডিজিটাল ভবিষ্যতের দিকে।

বিবিসি বাংলার হীরক জয়ন্তী বছরে আমরা যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখতে পারছি সেটা হলো ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থান। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই ডিজিটাল মিডিয়ার কম-বেশি উত্থান হয়েছে, বাংলাদেশ তাতে ব্যতিক্রম নয়। ডিজিটাল মিডিয়া সম্প্রসারণে বিবিসি বাংলা একটু বেশি সময় নিয়েছে, যেহেতু রেডিও শ্রোতাদের র চাহিদাও মেটাতে হয়েছে। একই লোকবল দিয়ে দৈনিক চারটি রেডিও অনুষ্ঠান ধরে রেখে অনলাইন এবং সামাজিক মাধ্যমে নতুন পাঠক গড়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে বিবিসি বাংলাকে তাই করতে হয়েছে এবং ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমাদের সাফল্যের একটি চিত্র দেখতে পেলাম।

তার আগের দু'বছর ধরেই সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে আমাদের ফলোয়ারের সংখ্যা ব্যাপক হাড়ে বেড়েছে। বছর তিনেক আগে আমাদের ফেসবুক ফলোয়ার ৫০,০০০ ও ছিলনা। কিন্তু ২০১৬ সালের মাঝা-মাঝি সময়ে তা ৮৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

শুধু 'লাইক' নয়, এনগেজমেন্ট, অর্থাৎ বিভিন্ন পোস্টে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ইত্যাদির দিক থেকেও পাঠকদের ব্যাপক তৎপরতা আছে বিবিসি বাংলার ফেসবুক পেজে। এই তৎপরতার ঢেউ অনিবার্যভাবে এসে পরে আমাদের ওয়েবসাইট, অর্থাৎ bbcbangla.com - এ।

বিগত বছরগুলোতে কয়েকটি ঘটনা আমাদের ওয়েবসাইটে ট্রাফিক হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়। যেমন, ২০১৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসীর রায়ের দিন; একই বছরে, ৬ই মে'র ভোরে ঢাকার শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলাম নামক মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠনের সমর্থকদের হটিয়ে দেয়ার ঘটনা; এবং ২০১৪ সালের পহেলা নভেম্বরে সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটার দিন।

কিন্তু পহেলা জুলাই-এ যা ঘটলো, সেটার জন্য হয়তো কেউই প্রস্তুত ছিল না। ঢাকার গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তার নির্বিচার নৃশংসতা সবাইকে হতবাক করে দিল। আরো অবাক করে দিল হত্যাকারীদের পরিচয় - পাঁচজন শিক্ষিত তরুণ, যাদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল ছিল বলে ধরে নেয়া যায়।

সব তথ্য যোগ দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সব চেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু - কূটনৈতিক পাড়ায় এমন এক রেস্তোরাঁ যেখানে বিদেশীরা নিয়মিত যান - নিশ্চিত করলো এই ঘটনা খবরের দিক থেকে বিশাল গুরুত্ব পাবে। ঘটনার গুরুত্ব আমাদের রেডিও শ্রোতা বা অনলাইন পাঠকরা দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যার প্রতিফলন আমরা দেখলাম আমাদের ফেসবুক এবং ওয়েবসাইটে।

আমাদের ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোতে তৎপরতা তাৎক্ষণিক ভাবে দেখার জন্য আমরা দুটো আ্যপ ব্যবহার করি - সোশাল মিডিয়ার জন্য সোশাল ফ্লো আর অনলাইনের জন্য চার্টবিট। যে কোন স্বাভাবিক দিনে, সোশাল ফ্লোতে আমরা দেখতে পাই আমাদের ফেসবুকে হাজার দুয়েক থেকে হয়তো ১৫,০০০ পাঠকের আনা-গোনা। কিন্তু সেদিন গভীর রাতে - বাংলাদেশে তখন রাত তিনটা পার হয়ে গেছে - দেখা গেল ৭৫,০০০-এরও বেশি লোক আমাদের ফেসবুক সাইটে সক্রিয়। চার্টবিট-এর তথ্য থেকে বোঝা গেল আমাদের ওয়েবসাইটের ট্রাফিকও সম্ভবত আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে - এবং তাই হলো।

তাই হলো। জুলাই মাসের ২ তারিখে আমাদের ওয়েবসাইটে প্রায় ৬০০,০০০ পাঠক বা ইউনিক ভিজিটর আসেন। গুলশানের রেস্তোরাঁয় আক্রমণের পর বাংলাদেশ, ফ্রান্স এবং তুরস্কে পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে যেগুলো নিয়েও পাঠকদের মাঝে বেশ আগ্রহ ছিল। ফলে, জুলাই মাসে অনলাইন এবং সোশাল মিডিয়া মিলে প্রায় ৬০ লক্ষ পাঠক বিবিসি বাংলার কনটেন্ট ব্যবহার করেন।

জুলাই মাস পরিষ্কার করে দিল যে বাংলাদেশে ডিজিটাল মিডিয়ার পূর্ণ উত্থান হয়েছে এবং বিবিসি বাংলা এই নতুন পাঠক সমাজের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রস্তুত।

পরিবর্তনের হাওয়া নতুন করে বইতে শুরু করেছে। এই হাওয়া নতুন একটি বিবিসি বাংলা সৃষ্টি করবে। কিন্তু সেই নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে অনেক পুরনো কিন্তু প্রিয় জিনিস হয়তো বিলীন হয়ে যাবে।