সিঙ্গুরের জমি ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশ
- শুভজ্যোতি ঘোষ
- বিবিসি বাংলা, দিল্লি

ছবির উৎস, AFP
সিঙ্গুরের কৃষাণীর হাতে জমি ফেরত দেয়ার দাবি নিয়ে প্ল্যাকার্ড।
ভারতে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর মোটর কারখানা স্থাপনের জন্য ১০ বছর আগে ওই রাজ্যের সরকার যে প্রায় ১০০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট বুধবার তা বাতিল ঘোষণা করেছে।
জমি নেয়ার ওই প্রক্রিয়াকে বেআইনি বলে বর্ণনা করে দেশের শীর্ষ আদালত সিঙ্গুরের কৃষকদের কাছে ওই জমি ফিরিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে।
বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ বদলানোর ক্ষেত্রে এককভাবে যে ইস্যুটির সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল, তা হল সিঙ্গুর।
কৃষকের জমি শিল্পের প্রয়োজনে কীভাবে নেয়া যাবে, সেই বিতর্কের পটভূমিতেই দেশের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল ২০০৬তে বামফ্রন্ট সরকারের জমি নেওয়ার ওই পদ্ধতি ভুল ছিল। অতএব তা এখন কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে হবে।
যারা গত ১০ বছর নিজের জমিতে চাষ করতে পারেননি, তাদের দিতে হবে ক্ষতিপূরণও।
তখনকার বামফ্রন্ট সরকারের সেই জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল সেই সিঙ্গুর আন্দোলনের।
ছবির উৎস, AFP
সিঙ্গুরে চাষের জমি কৃষকদের ফেরত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে প্রত্যাশিতভাবেই মানুষের জয় বলে দাবি করেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন জমি দিতে অনিচ্ছুক সিঙ্গুরের চাষীরাও।
তবে সিঙ্গুরের ওই জমি যে আর কোনওদিনই চাষের কাজে ব্যবহার করা যাবে না সেই বাস্তবতাও তারা মেনে নিয়েছেন।
বেলা দুটো বাজার একটু পরেই যখন সিঙ্গুরে খবর এল সুপ্রিম কোর্ট জমি অধিগ্রহণকে বাতিল ঘোষণা করেছে, তখন থেকেই আনন্দে ফেটে পড়ে হুগলী জেলার ওই ছোট জনপদ।
শাঁখ বাজিয়ে, স্লোগান দিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে রায়কে স্বাগত জানায় সিঙ্গুর। গত ১০ বছর ধরে যেখানকার বহুফসলি চাষের জমি নিয়ে চলছে এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক বিতর্ক।
মামলায় অন্যতম আবেদনকারী, সিঙ্গুরের কৃষক শান্তিরঞ্জন দাশের আইনজীবী দিল্লিতে জানান, দীর্ঘ অপেক্ষার পর তারা অবশেষে সুবিচার পেয়েছেন।
বেসরকারি শিল্প কারখানার জন্য সরকার জমির ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, এই যুক্তিতে ভর করে যিনি সিঙ্গুর আন্দোলনে নেমে কার্যত নিজের রাজনৈতিক জীবনকে বাজি রেখেছিলেন সেই মমতা ব্যানার্জিও বলেছেন আজ তাঁর 'খুশিতে চোখের জলও' মিশে আছে।
তিনি বলেন, "এই জয় গণদেবতার জয়, আন্দোলন-অনশনের জয়, মা-মাটি-মানুষের জয়। তবে সিঙ্গুরের মানুষ এতদিন বহু কষ্ট করেছেন, তাই আজ আমি খুশি হলেও বলব সেই আনন্দে কিন্তু অশ্রুও রয়েছে।''
ছবির উৎস, DIBYANGSHU SARKAR
মোটর কারখানার জন্য সিঙ্গুরে জমি ছাড়ার নোটিশ।
আগামী আড়াই-তিন মাসের মধ্যে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে সিঙ্গুরের চাষীরা যদি জমি ফেরতও পান, তাতে তারা আদৌ হয়তো কোনও দিন আর চাষ করতে পারবেন না । কারণ কারখানার জন্য সেখানে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
তারপরও এদিনের রায় তাদের জন্য বিরাট 'নৈতিক জয়' বলেই মনে করছেন কৃষক মহাদেব দাস বা সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় যার মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, সেই মনোরঞ্জন মালিক।
মি. মালিকের কথায় বুদ্ধবাবুর সরকার জোর করে জমি কেড়ে নিয়েছিল, মেয়েদের ওপর কত না অত্যাচার করেছিল। কিন্তু দেশে যে আইন বলে কিছু আছে, ভগবান সেটাই দেখিয়ে দিলেন।
২০০৬তে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন যিনি, সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এখন প্রায় অবসরে। তবে তাঁর দল সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র দাবি করেছেন, তারাও জমি ফেরত দিতে চেয়েছিলেন, তবে অন্য উপায়ে।
বুধবারের রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির রায়ের মধ্যেও যে কিছুটা মতভেদ ছিল, সে কথা উল্লেখ করে সূর্যকান্ত মিশ্র তামিলনাডুর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, তারাও ওই পদ্ধতিতেই চাষীদের জমি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
এই রায়ের পর টাটা শিল্পগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেছে।
তবে তাদের এক মুখপাত্র মনে করিয়ে দিয়েছেন, সিঙ্গুর নিয়ে তারা নিজেরা যে আপিল করেছে সুপ্রিম কোর্টে তার শুনানি এখনও শুরুই হয়নি।