সন্ত হলেও সমালোচনা থেকে রেহাই নেই তেরেসার

  • শুভজ্যোতি ঘোষ
  • বিবিসি বাংলা, দিল্লি
মাদার তেরেসা
ছবির ক্যাপশান,

মাদার তেরেসার জন্ম ১৯১০ সালে, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন কলকাতায়

মাদার তেরেসার 'ক্যানোনাইজেশন' বা সেইন্টহুডের স্বীকৃতিকে ঘিরে কলকাতাতেও আজ দিনভর চলছে আনন্দোৎসব - যে শহরকে তিনি নিজের সারা জীবনের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

এই উপলক্ষে মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র সদর দফতর, মধ্য কলকাতার মাদার হাউসের বিশেষ প্রার্থনায় সামিল হয়েছিলেন বহু মানুষ। তবে সেইন্ট তেরেসা অব ক্যালকাটাকে নিয়ে শহরের মানুষ যেমন গর্ব করছেন, তেমনি তার সমালোচকের সংখ্যাও কিন্তু একেবারে কম নয়।

তেরেসার সেবার পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মান্তর - এই অভিযোগ যেমন তাকে জীবদ্দশায় শুনতে হয়েছে, তেমনি আজও সেই সমালোচনা থামেনি।

ম্যাসেডোনিয়াতে জন্মানো অ্যাগনেস ১৯২৯ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে ভারতে পা রেখেছিলেন।

তার মাত্র দু'বছরের মধ্যেই তিনি নান হিসেবে শপথ নেন, তারপর দার্জিলিংয়ে ও কলকাতার লোরেটো কনভেন্টে প্রায় দুই দশক ধরে শিক্ষকতার মাঝেই তিনি স্থির করে ফেলেছিলেন, দুস্থের সেবাই হবে তার সারা জীবনের ব্রত আর সেই সেবার প্রধান কেন্দ্র হবে কলকাতা।

ফলে আজ রোমান ক্যাথলিক চার্চ যখন তেরেসাকে সেইন্ট হিসাবে সম্মান জানাল, সেই বিরল গৌরবে যথারীতি শরিক ছিল কলকাতাও।

ছবির উৎস, Reuters

ছবির ক্যাপশান,

কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি

শহরের অর্চবিশপ টমাস ডিসুজার কথায়, "তেরেসা ছিলেন করুণা ও মায়ামমতার মূর্ত প্রতীক। যখনই তাকে দেখেছি, তিনি ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী, সব সময় সবাইকে যে কোনও সাহায্য করতে ব্যগ্র। খুব আনন্দময় ছিলেন, তার হৃদয়ে যে ঈশ্বরের বাস এটা সবাই বুঝতে পারতেন।"

তবে শুধু সেইন্ট তেরেসার এককালের সহকর্মীরাই নন, শহরের আপামর সাধারণ মানুষও ভ্যাটিকানের দেওয়া এই সম্মানে আপ্লুত - কারণ তারা অনেকেই এটাকে কলকাতা তথা ভারতের সম্মান বলে মনে করছেন।

এরা কেউ বলছেন, "মাদার যে শহরে ছিলেন আমিও সেই শহরের সেটা ভেবেই গর্ব হচ্ছে।"

কেউ আবার বলছেন, "মাদার যেহেতু তার কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতকেই বেছে নিয়েছিলেন তাই আজ গোটা ভারতেরই বড় আনন্দের দিন।"

কলকাতার বরেণ্য লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় খবরের কাগজে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, মাদার ছিলেন এমন এক অদ্ভুত মানুষ যিনি তাঁর সেবার মধ্যে দিয়ে কলকাতাকে আত্মগ্লানিতে ফেলে দিয়েছিলেন, অনুতাপের দগ্ধে মেরেছিলেন।

তবে সবাই যে সেইন্ট তেরেসার এই সেবার ভূমিকাটিকেই বড় করে দেখছেন তা নয় - 'মাদার তেরেসা : দ্য ফাইনাল ভার্ডিক্ট' নামে বইটির লেখক ও তেরেসার তীব্র সমালোচক অরৌপ চ্যাটার্জির মতে, হাজার হাজার মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তর করাটাই তার সবচেয়ে বড় অন্যায়।

ছবির উৎস, AP

ছবির ক্যাপশান,

মাদার তেরেসাকে কলকাতায় সমাহিত করা হয়

ড: চ্যাটার্জির কথায়, "তেরেসা নিজেই ১৯৯২ সালে স্বীকার করেন, তিনি প্রায় ২৯ হাজার লোককে তাদের মৃত্যুর সময় না জানিয়ে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করান। আমার মতে আসল সংখ্যাটা লক্ষের কাছাকাছি হবে।"

"হিন্দু বা অন্য পৌত্তলিক ধর্মকে ছোট করে, শয়তানের ধর্ম বলে চিহ্নিত করে একটি গোঁড়া ক্যাথলিক মধ্যযুগীয় ধারণা তিনি প্রচার করেছিলেন - যা গর্ভ-নিরোধক অবধি ব্যবহার করতে দেয় না, এমন কী ধর্ষিতা হলেও গর্ভপাতের অনুমতি দেয় না," বলছেন তিনি।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো নানা কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনও তেরেসার বিরুদ্ধে এই একই অভিযোগ এনেছে, এমন কী আজ ভ্যাটিকানের অনুষ্ঠানে সরকার যাতে কোন প্রতিনিধিদল না-পাঠায় তার জন্য ব্যাপক প্রচারও চালিয়েছে।

তবে তা সত্ত্বেও ভারত সরকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে ওই অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছে - এবং পাশাপাশি মিশনারিজ অব চ্যারিটিও দাবি করেছে তেরেসার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

মাদার হাউসের মুখপাত্র ও তেরেসার তিরিশ বছরের সহকর্মী সুনীতা কুমার বলছেন, "তিনি ধর্মের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন - ফলে তার কাউকে ধর্মান্তরিত করার প্রশ্নও ওঠে না। সেটা কখনওই তার উদ্দেশ্য ছিল না, আর তাই যদি হত আমার তো মনে হয় গোটা ভারত এতদিনে খ্রিষ্টান হয়ে যেত।"

তবু এই বিতর্ক থাকছেই। তেরেসার প্রয়াণের ঠিক উনিশ বছরের মাথায় এসে তিনি সেইন্ট তেরেসা অব ক্যালকাটা হলেন ঠিকই, কিন্তু নোবেল জয়ের পরেও যেমন তিনি সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি - তেমনি এখনও পাচ্ছেন না!