ব্যাটল ট্যাংকের একশ বছর
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম ট্যাংকের ব্যবহার হয়েছিল ১৯১৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ এখন থেকে একশ বছর আগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে সমের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী নতুন এই মারণাস্ত্র ব্যাবহার করেছিলো।
অত্যন্ত গোপনে নির্মাণ করা হয়েছিলো ট্যাংক। এমনকি প্রথম যারা তা ব্যবহার করেছিলেন তারাও প্রথম এই অস্ত্র দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
বিবিসির আর্কাইভে রাখা একজন সৈন্যের অভিজ্ঞতা ছিল এরকম--"আমরা কিছুই জানতাম না। কোথায় ঢুকছি, কেন ঢুকছি বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের শুধু সাবধান করা হয়েছিলো, এটি খুবই বিপজ্জনক।"
আরেকজনের স্মৃতিচারণ ছিল এরকম, "প্রথমবার যখন ট্যাংকের মধ্যে ঢুকেছিলাম, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো পুরো পৃথিবী থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। একবার ঢুকে গেলে বাইরের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায় ছিলোনা। ভেতরের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছিলো। বাইরের অবস্থা চোখে দেখার একমাত্র উপায় ছিলো লোহার তৈরি একটি পেরিস্কোপ। ভেতরের পরিবেশটা ছিলো প্রচণ্ড বিষাদময় আর ঘাম ঝরানো গরম।"
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম ট্যাংক দেখে তাদের কি মনে হয়েছিলো তা বর্ণনা করেছিলেন একজন জার্মান সৈন্য।
"বিশালাকৃতির এই মেশিনটি আমরা যখন দেখলাম, দানবের মত মনে হচ্ছিলো। বুঝতে পারছিলাম না এটা ঠিক কি। আগে কোনোদিন এরকম কোনো কিছু আমরা দেখিনি। ওগুলো যখন আমাদের ট্রেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছিলো, আমরা ভেবেছিলাম বার্লিনের দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের হয়তো কোনো উপায় নেই।"
ছবির উৎস, ADRIAN DENNIS
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্যাংক
প্রথম মহাযুদ্ধে ট্রেঞ্চ অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে সুড়ঙ্গ তৈরি করে লড়াইতে যেভাবে প্রাণ যাচ্ছিলো -- তা এড়াতে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স বিকল্প ভাবতে শুরু করেছিলো। তারা এমন কোনো অস্ত্রের কথা ভাবছিলো যা দিয়ে মেশিনগানের গুলি-বৃষ্টির ভেতর কাঁটাতারের দেয়াল অতিক্রম করে জার্মান ট্রেঞ্চে পৌঁছুনো যাবে।
আর সেই চিন্তা থেকে যেটা তৈরি হলো তা ছিলো ইস্পাতে মোড়া অস্ত্র বসানো ধীরগতির ভারি একটি যান যা ট্রাক্টরের মত দেখতে । এবড়ো-থেবড়ো উঁচু-নিচু জমি দিয়ে যাতে চলতে পারে, সেজন্য ব্রিটিশরা ঐ ট্রাক্টরের সাথে জুড়ে দিয়েছিলো ভারী লোহার চেন, যেগুলো তখন কৃষি যন্ত্রে ব্যবহার হতো।
নতুন এই সমরাস্ত্র তৈরির কথা যাতে জার্মানরা জানতে না পারে, সেজন্য ছড়ানো হয়েছিলো পানি ধরে রাখার জন্য ইস্পাতের ট্যাংক তৈরি করা হচ্ছে। ট্যাংক নামটি সেখান থেকেই।
প্রথমে মাত্র কয়েকডজন ট্যাংক ইংলিশ চ্যানেল পার করে ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিলো। একেকটিতে একজন সেনা অফিসার এবং সাতজন করে ক্রু ছিলো।
প্রথম যখন এগুলো যাচিছলো, রাস্তার দুধারের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়।
মানুষের সেই বিস্ময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন একজন ট্যাংক ক্রু -- "আগ্রহী বহু মানুষ আমাদের পাশাপাশি হাটছিলো। খোলা দরজা দিয়ে আমাদের প্রশ্ন করছিলো -- এটা কি জিনিস, এটা দিয়ে কি ট্রেঞ্চে ঢোকা যাবে, এতে কতগুলো বন্দুক আছে, এটার ক্ষমতা কতটা, ইস্পাতের দেয়াল কতটা পুরু - ইত্যাদি নানা প্রশ্ন।"
প্রথম দিকে দু ধরণের ট্যাংক বানানো হতো -- কোনোটি ফিমেল অর্থাৎ মহিলা ট্যাংক। সেগুলোতে শুধু মেশিনগান থাকতো। অন্যটি পুরুষ ট্যাংক, সেগুলোতে কামান বসানো।
ছবির উৎস, HAIDAR MOHAMMED ALI
আধুনিক ট্যাংক
১৯১৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রথম যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার শুরু হয়। ফ্রান্সের ফ্লর নামে ছোটো একটি শহরের কাছে একটি জার্মান ট্রেঞ্চে হামলার জন্য তিনটি ট্যাংক পাঠানো হয়।
প্রথম অভিজ্ঞতা ভালো ছিলনা। অভিযান শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনটি ট্যাংকের মধ্যেই দুটোই গর্তে আটকে যায়। পরিত্যক্ত করা হয়। শুধু লে. হেইস্টি নামে এক অফিসার ট্যাংক নিয়ে জার্মান ট্রেঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন।
তবে ট্যাংকের ওপর কতটা ভরসা করা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করার আগেই সেগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অকেজো হয়ে পড়ে।
ট্যাংক তৈরি করে চমক দিতে পারলেও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশ বাহিনী খুব যে সুবিধা করতে পেরেছিলো তা নয়। তার প্রধান কারণ ছিলো -- সংখ্যায় সেগুলো খুব কম ছিলো, আর তাছাড়া প্রাথমিক ধাক্কা এবং বিস্ময়ের পর জার্মানরা নতুন এই অস্ত্রের মোকাবেলায় কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছিলো।
ট্যাংকগুলোর ওপর ম্যানহোলের ভেতরে গ্রেনেড ছুড়ে সেগুলোকে কাবু করতে শুরু করে জার্মানরা।
তবে একের পর পর এক চেষ্টার পর ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশদের ট্যাংক হামলায় বড় ধরণের সাফল্য পাওয়া গিয়েছিলো। তবে ট্যাংকের ওপর তেমন ভরসা করতে না করায় ব্রিটিশ কম্যান্ডাররা এটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এ থেকে প্রত্যাশিত সাফল্যও তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পাননি।
ট্যাংকের হামলায় জার্মানরা দ্রুত ধরাশায়ী হয়ে পড়বে - এরকম প্রত্যাশা বাস্তবে ততটা পূরণ হয়নি। তবে পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে একটা সময় পর এই মারণাস্ত্রের অসামান্য ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছিলো।
ট্যাংক আধুনিক যুদ্ধের চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলো।