ক্যাথলিক চার্চে শিশুদের যৌন নিপীড়ন উদ্ঘাটিত হলো যেভাবে
উনিশশ' চুরানব্বই সালের অক্টোবর মাস। বেলফাস্টের ইউটিভি নামের টিভি চ্যানেলে 'কাউন্টারপযেন্ট' অনুষ্ঠানে একটি রিপোর্ট প্রচার হলো - যা ছিল ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেবার মতো ঘটনা।
আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে যাজকদের হাতে কি হারে শিশুদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে - তা প্রথম বারের মতো এই অনুষ্ঠানে ফাঁস করা হলো।
অনুষ্ঠানে একজন স্পষ্ট বললেন একজন যাজকের হতে তার শৈশবে কি অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার কথা।
"আমার পরনে ছিল স্কার্ট - যা স্কুলের পোশাক। তিনি বললেন, তোমার স্কার্ট তোলো । আমি ভয় পেয়ে গেলাম - বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো। তিনি বললেন , এসো আমার হাঁটুর ওপর বসো। তার পর আমি অনুভব করলাম, তার হাতটা আমার পা বেয়ে উঠছে - আমার স্কার্টের ভেতরে। আমি কাঁদছিলাম। এক সময় তিনি আমার দেহের গোপন অংশে হাত দিলেন।"
এটা ছিল বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের সবচেয়ে হতবাক করার মত ঘটনাগুলোর একটি।
ওই অনুষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ক্রিস মুর।
এর পর আরো অনেকেই প্রকাশ করতে শুরু করেন চার্চের যাজকদের হাতে তাদেরও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা।
পরে এরই সূত্র ধরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে শিশুদের যৌন নিপীড়নের বহু কাহিনী প্রকাশ পায়। ক্ষোভ সৃষ্টি হয় বিশ্বব্যাপী। এক পর্যায়ে তৎকালীন পোপ বেনেডিক্টকেও এ জন্য দু:খ প্রকাশ করতে হয়।
তবে এ সবকিছুরই সূচনা হয়েছিল বেলফাস্টের ইউটিভির ওই অনুষ্ঠানটি দিয়ে।
'সাফার লিটল চিল্ডরেন' নামের ওই অনুষ্ঠানটিতে ছিল একজন ক্যাথলিক যাজকের গল্প। যিনি ছিলেন একজন শিশুকামী, এবং যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছেন।
এই শিশুদের মধ্যে কারো কারো বয়েস ছিল মাত্র ৬ এবং তাদের মধ্যে ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশু - সবাই আছে।
যে অনুসন্ধানী সাংবাদিক প্রথম সেই টিভির অনুষ্ঠানটি করেছিলেন - সেই ক্রিস মুরের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির রেবেকা কেসবি।
ক্রিস মুর বলছিলেন,"অনুষ্ঠানটি প্রচার হবার আগে পর্যন্ত আমি বুঝতে পারি নি যে এসব ঘটনা কত ব্যাপক । এটার গুরুত্ব যে কত - তাও বুঝিনি। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটি একটা অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা ভেঙে দিয়েছিল, একটা বন্ধ দরজা খুলে গিয়েছিল।"
ক্রিস মুরের কর্মস্থল ছিল বেলফাস্ট-এ। তবে তার তৈরি ওই অনুষ্ঠানটি উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র দু-জায়গাতেই প্রচার হয়েছিল।
এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সাথে সাথেই, এবং তা হয়েছিল সুদুর প্রসারী।
শুধু ক্যাথলিক চার্চই নয়, গোটা দেশ, এবং শিশুদের যৌন নিপীড়নের ব্যপারে সারা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গীরর ওপরও এর প্রভাব পড়েছিল।
অনুষ্ঠানটি প্রচার হবার কয়েকদিন পরই ডাবলিনে ধর্ষণের শিকারদের সহায়তা দেবার যে কেন্দ্র ছিল -তাদের কাছ থেকে একটি ফোন পেলেন ক্রিস মুর।
ক্রিস মুর বলছিলেন, তাদের কাছে তখন বানের জলের মতো ফোন আসতে শুরু করেছে।
"যে মহিলাটি আমাকে ফোন করেছিলেন , তিনি বললেন অনুষ্ঠান প্রচারের পর থেকেই তাদের কাছে অসংখ্য ফোন আসছে, এবং সেই কলাররা সবাই তাদের নিজেদের যৌন নির্যাতনের শিকার হবার কথা বলছেন। তারা বলছেন, তারা এতদিন এসব কথা গোপন রেখেছিলেন, দশকের পর দশক ধরে। একজন ফোন করেছিলেন তার বয়েস এখন তিরাশি। তিনি তার শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন এবং তা তিনি এতদিন কাউকে বলেন নি। তার কাহিনি শুনে আমাদেরই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে।"
ক্রিসের এ নিয়ে রিপোর্ট করার ভাবনা মাথায় এসেছিল এক বড়দিনের পার্টিতে একজন মহিলার সাথে পরিচয়ের পর। তিনি ফাদার ব্রেন্ডন স্মিথ নামে একজন ক্যাথলিক যাজকের যৌন নিপীড়নের কথা সবাইকে জানিয়ে দিতে চাইছিলেন।
মহিলাটির অভিযোগ ছিল , তাকে এবং তার বোনকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন ফাদার স্মিথ। শুধু তাই নয়, বেলফাস্টের একই পরিবারের অন্য কয়েকটি শিশুকে নির্যাতনের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে।
কিন্তু তিনি এর পর আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের ডাবলিনে চলে যান -তাই তাকে গ্রেফতার করা যায় নি, এবং তাকে বিচারের জন্য ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছিল।
যে পরিবারটি এই ফাদার স্মিথের বিরুদ্ধে প্রথম পুলিশে রিপোর্ট করে তার সাথে দেখা করলেন ক্রিস মুর।
তিনি জানতে পারলেন এই ফাদার স্মিথ শুধু যে তাদের গীর্জার পুরোহিত ছিলেন তাই নয় একজন পারিবারিক বন্ধুও ছিলেন।
ছবির উৎস, Getty Images
বিভিন্ন দেশে যাজকদের যৌন নিপীড়নের ঘটনার বিচার হয়েছে
"এই পরিবারটিই প্রথম তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ আনে। কারণ তাদের পরিবারের চারটি শিশু এমন একজনের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় - যিনি তাদের বাড়িতে আসতেন, একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। যখন পরিবারের বড়রা খাবার টেবিলে, ডিনার করছে, তখন ওই শিশুরা তাদের বেডরুমে খেলছিল। তিনি সেই ঘরে ঢুকে তাদের যৌন নিপীড়ন করেন। তাদের কয়েকজন আত্মীয়ও একই ভাবে নিপীড়নের শিকার হয়। তারা অনেক বছর এ ঘটনা গোপন রেখেছিলেন। তারা চার্চ ও পুলিশের কাছেও গিয়েছিলেন, এবং তাদের বার বার আশ্বাস দেয়া হয় - এমন আর ঘটবে না। কিন্তু তার পরও এটা বন্ধ হয় নি। এরকম ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে - শত শত, হাজার হাজার । মনে হয়, সবখানেই এমন হচ্ছে।"
এর পর অন্য আরো ক্যাথলিক যাজকদের ঘটনা বের হতে লাগলো - যাদের হাতে শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর এসব ঘটনার শিকার হয়েছিলেন এমন অনেকেই ক্রিসের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চাইলেন।
"আমি ভাবলাম, এটা আমার কর্তব্য অন্যদের কথা শোনা। আমি কাউকে ফিরিয়ে দিই নি। তারা নিজে থেকেই ওই সব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, অনেকে কেঁদেছেন। তাদের কথা শুনে আমার নিজেকে সামলে রাখা সহজ ছিল না। কিন্তু বাড়ি ফিরে , একান্তে আমার স্ত্রীকে যখন আমি এসব কথা বলেছি, তখন আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। এতই ভয়াবহ সে সব ঘটনা।"
ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এসব ঘটনার কথা শোনার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ক্রিসের নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও।
"যখন আমার প্রথম নাতির জন্ম হলো - তার পর বেশ কয়েকবার সে আমাদের বাড়িতে ছিল। একবার আমার স্ত্রী আমাকে বললো, আমি লক্ষ্য করেছি তুমি কখনো ওর ন্যাপি পাল্টে দাও না। কারণটা কি? আমি বলেছিলাম আমার সমস্যা হয়। আমি যেসব ভয়াবহ গল্প শুনেছি, তার পর তাকে আমি স্পর্শ করতে চাই না। তখন আমার স্ত্রী বললো, তোমার সাহায়্য দরকার। আমার সাহায্য নিতে হয় নি, তবে এর পর থেকেই আমি যৌন নিপীড়নের শিকারদের ফোন ধরা , বা তাদের সাথে কথা বলা - বন্ধ করে দিলাম। আমি আর এসব নিতে পারছিলাম না। তাদের বেদনা উপশম করার ক্ষমতা আমার আর ছিল না। আমি অনুভব করছিলাম, আমি শক্তিহীন হয়ে পড়ছি।"
আয়ারল্যান্ডের এই ঘটনার পর , কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশেও অনেকেই যাজকদের যৌন নিপীড়নের শিকার হবার ঘটনা ফাঁস করে দিতে লাগলেন। ক্যাথলিক চার্চ একটা সংকটে পড়ে গেল। ক্রিস নিজেও কিছুদিনের বিরতির পর আবার এ বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তার অনুসন্ধানের এবারের বিষয় হলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে চার্চ নিজেই। তারা এসব ঘটনার ব্যাপারে কতটুকু জানতো? কেন তারা এসব থামাতে ব্যর্থ হলো? এসব প্রশ্নই তুলতে লাগলেন ক্রিস ।
"চার্চ এ সম্পর্কে বহু কিছুই জানতো। তারা যাজকদের অবাধে এসব কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে দিয়েছে। চার্চগুলোর গোপন ভল্টে এমন সব কাগজপত্র পাওয়া গেছে যাতে দেখা যায় - তারা নির্যাতনকারী যাজকদের সম্পর্কে বিশদ তথ্যসমৃদ্ধ দলিলপত্র রাখতো। নির্যাতনের শিকাররা যেসব কথা তাদের বলেছে, সেসব খুঁটিনাটি তথ্যও তারা সংরক্ষণ করেছে। পরে এসব তথ্য পুলিশের জন্য অনেক কাজে লেগেছে। কারণ এতে নিশ্চিত হয়েছে যে চার্চ এ বিষয়ে জানতো, এবং নিপীড়নের শিকাররা যা বলেছিল তা-ও এসব দলিল থেকে নিশ্চিত করা গিয়েছিল। এসব কথা তাদের নিজেদের হাতেই লেখা ছিল । তার পরেও তারা এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। চার্চের সুনাম রক্ষাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।"
ছবির উৎস, Franco Origlia
পোপ বেনেডিক্ট পরে এসব ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করেন
ক্রিস যা উদঘাটন করলেন, তা ছিল অত্যন্ত গুরুতর।
"আমি কখনোই মনে করি না যে সব যাজকই এমন । কিন্তু শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা যারা জেনেও গোপন রেখেছে. এবং নির্যাতনকারীদের আইনের হাতে তুলে দেয় নি - তারাও একই অপরাধে অপরাধী।"
ক্রিস বরাবর বলে এসেছেন যে এসব ঘটনাকে 'ধর্ষণ এবং এক ধরণের অত্যাচার বলে অভিহিত করা উচিত ।
"সংবাদ মাধ্যমে এসব ঘটনাকে যাজকদের যৌন নিপীড়ন বলা হয় - এটা ঠিক নয়। আমাদের এসব ঘটনাকে এভাবে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে উপস্থাপন করা উচিত নয়, ক্যাথলিক চার্চের জন্য ব্যাপারটাকে সহজ করে দেয়া উচিত নয়। এগুলো যা - ঠিক সেভাবেই তাকে বর্ণনা করা উচিত। আমাদের বলা উচিত - এরা হচ্ছে ধর্ষণকারী যাজক। এটা এমন কোন ঘটনা নয় যেখানে একজন নির্দোষ যাজক একটি মেয়ের পা স্পর্শ করছে। এটা হচ্ছে একজনের নিজ দেহের সম্ভ্রমকে লংঘন করা।"
পরে ফাদার ব্রেন্ডন স্মিথের কারাদন্ড হয়। আয়ারল্যান্ডে যৌন নিপীড়নকারী যাজকদের সংখ্যা এবং কয়েক দশকেও যে এসবের কোন শাস্তি হয় নি- এটা প্রকাশ পাবার পর ২০১০ সালে পোপ বেনেডিক্ট এ জন্য দু:খ প্রকাশ করেন।
"যারা এসব ঘটনার কথা বলতে এগিয়ে এসেছেন -তারা আমাকে বিস্মিত করেছে। আর ক্যাথলিক চার্চের প্রেস অফিস যেভাবে এসব অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছে - তাও আমাকে অবাক করেছে। তারা আমাকে বলতো কিভাবে আপনি রিপোর্ট করছেন, তাতে কি বলছেন তা নিয়ে সাবধান থাকবেন। তারা বলতো, এতে অনেক ভালো মানুষ আহত হবেন। আমি জবাবে বলেছি, অনেক ভালো মানুষ ইতিমধ্যেই আহত হয়েছে। আপনাদের বরং সেটা নিয়েই ভাবা উচিত। এখানে তো আপনাদের উচ্চ নৈতিক অবস্থানের কোন সুযোগ নেই। লোকে এখন তার গোপন কথা আরেকজন জেনে যাবে - এই ভয়ে ভীত নয়।"
ক্রিস মোর এখনো বেলফাস্টেই থাকেন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তিনি একাধিক বইও লিখেছেন।