'তিন প্রজন্মে সাঁওতালদের সাড়ে ৩ লক্ষ বিঘা জমি বেহাত হয়েছে'

গাইবান্ধায় সহিংসতার পর বাস্তুচ্যুত সাঁওতালরা।

ছবির উৎস, BBC Bangla

ছবির ক্যাপশান,

গাইবান্ধায় সহিংসতার পর বাস্তুচ্যুত সাঁওতালরা। একটি সংস্থা বলছে, ২০০৭-১৫ পর্যন্ত আট বছরে সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমি কেন্দ্রিক ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছে

বাংলাদেশে সমতল ভূমির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালরাই সবচে বেশি ভূমি সমস্যার শিকার বলে বলছেন গবেষকরা। যারা গত তিন প্রজন্মে তিন লক্ষ বিঘা জমি হারিয়েছে, যার বাজার মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এখন প্রায় চার লাখ সাঁওতাল বসবাস করছে।

গাইবান্ধায় রংপুর সুগার মিলের অধীনে থাকা ১৮৪২.৩০ একর জমির অধিকার নিয়ে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হন। ৫০এর দশকে আখ খামার গড়ে তুলতে সাঁওতালসহ স্থানীয়দের কাছ থেকে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

আরো দেখুন:

যেখানে সাঁওতালদের ১৫টি এবং বাঙালীদের ৫টি গ্রাম ছিল। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাস্কে দাবি করেন, অধিগ্রহন ছাড়াও ওই সময় ৬২২ একর জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবুল বারকাত গবেষণা করে বলছেন, গত তিন প্রজন্মে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাড়ে তিন লক্ষ বিঘা জমি বেহাত হয়ে গেছে যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আবুল বারকাতের এই গবেষণা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

ছবির উৎস, BBC Bangla

ছবির ক্যাপশান,

গাইবান্ধায় চিনি কলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার সময় তাদের বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়

সম্প্রতি গাইবান্ধায় চিনি কলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পর ঐ ঘটনা পরিদর্শন করেছেন আবুল বারকাত। তিনি বলেন, ঐ জমির অধিকাংশই সাঁওতালদের মালিকানায় ছিল। বাগদাফার্ম নামটাই বাগদা সরেনের নামে যিনি ছিলেন সাঁওতাল।

মি. বারকাত বলেন, "২০১৪ সালের মূল্যমানে দশ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জমি-যাতি সমতল ভূমির আদিবাসীর হাত থেকে চলে গেছে অন্যের হাতে। তার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে ৫৩% হচ্ছে সাঁওতালদের। আমি যেটা পাই গত তিন প্রজন্মে তাদের সাড়ে তিন লক্ষ বিঘার মতো জমি চলে গেছে। যে জমির বর্তমান মূল্যমান ৫ হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে।"

ছবির উৎস, BBC Bangla

ছবির ক্যাপশান,

গোবিন্দগঞ্জের বিরোধপূর্ণ জমির চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া তুলে দিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ধানক্ষেত। নিজেদের রোপণ করা ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সাঁওতাল নারী।

তিনি গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, সমতলের ১০টি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালদের জমিই সবচে বেশি বেদখল হয়েছে। কেন সাঁওতালদের জমি এত বেশি বেহাত হলো এরও ব্যাখ্যা দেন মিস্টার বারকাত।

তিনি বলছেন,"জমির ওপর তাদের গোষ্ঠীগত মালিকানা ছিল। জমির ওপর যখন ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকে তাহলে দলিল থাকার কথা না। দলিল নাই জমি আছে। এই জমি একসময় বেশি দাম ছিল না। জমি দুষ্প্রাপ্য হওয়া শুরু করলো তখন অআদিবাসী যারা তারা বুঝলো যে এই জমির দলিল বানাইতে পারলে জমির মালিক হওয়া যায়। জাল দলিল ভুয়া দলিল ইত্যাদি একটা বড় কারণ।"

তিনি বলেন, "এগুলো দখল করেছেন সমাজের উপরের দিকে যারা। এবং উপরের দিকে যারা তারা সবসময় একটা রাজনৈতিক দল ফলো করেন। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তারা সব সময় সরকারি দলেই থাকেন"।

কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যে ২০০৭-১৫ পর্যন্ত আট বছরে সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমি কেন্দ্রিক ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৩০ জন আহত এবং ১৬ জন সাঁওতাল নিহত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে হিসেব রাখার পর দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই সাঁওতালদের জমি সংক্রান্ত বিরোধের ঘটনা বাড়ছে।

ছবির উৎস, BBC Bangla

ছবির ক্যাপশান,

চিনিকলের জমি থেকে উচ্ছেদের পর গাইবান্ধায় বাস্তুচ্যুত সাঁওতাল পরিবার

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, "দিনাজপুরের ঢুডু সরেনের বাবাকে পাকিস্তান আমলে হত্যা করা হয়েছে, ২০১১ সালে তার ভাইকে মারা হয়েছে এবং ঢুডু সরেন নিজেই নিহত হয়েছেন প্রকাশ্য দিবালোকে ভূমি শত্রুদের হাতে এবং তারাও ক্ষমতাসীন দলের লোক"।

মিস্টার সরেন বলেন, সবক্ষেত্রেই দেখা যায় ক্ষমতা এবং প্রভাবশালীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে সাঁওতালরা।

তিনি বলেন,"শত শত ঘটনা আছে যার বিচার আজও হয়নি। কোনো হত্যার বিচার হয়নি। বিচারও তারা পাচ্ছে না। থানায় যাবে মামলা নিচ্ছে না। দেখা গেছে বরং আদিবাসীদের ওপর মামলা চাপিয়ে দিচ্ছে ভূমি দস্যুরা, প্রভাবশালীরা।"

সাঁওতাল জনগোষ্ঠী বলছে, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেবল ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে। ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে সমতলেও একটি স্বাধীন ভূমি কমিশন চাইছে সাঁওতালসহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীরা।