ঢাকার ‘হোমলেস’দের বিচিত্র নিশি যাপন
- আহ্রার হোসেন
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

দশ বছর ধরে বাংলামোটরের ফুটপাতেই সংসার মোরশেদা বেগমের পরিবারের।
বাংলামোটর মোড় থেকে মগবাজার চৌরাস্তায় যাওয়ার পথে ফুটপাতে বড়সড় একটি মশারি টাঙাচ্ছিলেন চল্লিশোর্ধ এক মহিলা।
মাকে মশারি টানানোয় সাহায্য করছে তার কমবয়সী মেয়ে।
মশারির ভেতরে লাইন দিয়ে পাঁচটি বালিশ সাজানো।
পাশেই বসে এক তরুণী, তার কোলে একটি শিশু।
আরো একটি কমবয়সী মেয়ে তরুণীটির চুল বেঁধে দিচ্ছে। এরা সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই হল মোরশেদা বেগমের পরিবার।
এই ফুটপাতেই বড় হয়েছে মোরশেদা বেগমের ৫ মেয়ে।
দুজনকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠিয়েছেন। তার সঙ্গে এখন থাকেন বাকী তিন মেয়ে, এক নাতনী।
মা ও দুই মেয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করে। একজন সন্তানের দেখভাল করে।
যে টাকা পান তা দিয়ে একটি ঘর নিতে পারেন না? জানতে চাই।
"কেমনে ঘর ভাড়া করুম বাবা", মোরশেদা বেগমের জবাব।
"অল্প যা পাই তা এতগুলা পেট ভরাতেই খরচ হইয়া যায়"।
রাত এগারোটা বাজে, সামনে দিয়ে তারস্বরে হর্ন বাজিয়ে, চোখ ধাঁধানো আলো জ্বেলে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি।
এই পরিবারটির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। দশ বছরের অভ্যস্ততা।
ফুটপাতের বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম।
ঝড়-বাদলা না হলে এক ঘুমে রাত কাবার।
রাতের বেলা ঢাকার একদল সহায়-সম্বলহীন মানুষ বিছানা পাতেন সড়ক-দ্বীপে, ফুটপাতে, গাছের তলায়।
রাতের বেলা ঢাকার লাখ লাখ নাগরিক যখন ফিরে যান আপন নিবাসে, তখন একদল সহায়-সম্বলহীন মানুষ বিছানা পাতেন সড়ক দ্বীপে, ফুটপাতে, গাছের তলায়।
পৃথিবীর সব মেগাসিটির মতই ঢাকাতেও দেখা যায় হোমলেস বা গৃহহীনদের।
গভীর রাতে ঢাকার রাস্তায় মোরশেদাদের মত সপরিবারে ঘুমিয়ে থাকা কম রোজগেরে শ্রমিকদের যেমন চোখে পড়বে, তেমনি দেখা মিলবে রাতজাগা অপরাধী, মাদকাসক্ত, ভাসমান যৌন কর্মীদের।
হৃদয় ছোঁয়া গল্প:
হাইকোর্ট চত্বর এলাকায় এসে চোখে পড়ে বর্ণিল সব চরিত্র।
বিচিত্র তাদের কর্মকাণ্ড।
তবে একটি জায়গায় সবাই এক।
এদের কারোরই ঘর নেই।
প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সব গল্প।
চার বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন নদী (ছদ্মনাম)।
এতদিন ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষে করেছেন।
ছেলে বড় হওয়ার পর তাকে গ্রামে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একটি চাকরিও পেয়েছেন নদী - একটি এনজিওর হয়ে রাতের বেলায় ভাসমান যৌনকর্মীদের মাঝে কনডম বিতরণের চাকরি।
রাত জেগে কাজ, সুযোগ পেলে একটু ঘুমিয়ে নেন সামনের বটতলায়।
দিনের বেলায় হাজিরা দিতে হয় এনজিওর অফিসে।
ফুটপাতের অন্ধকার অংশে দাঁড়িয়ে আগুন পোয়ানো এই মহিলার পেশা জানতে চাইলে তিনি নিঃসঙ্কোচ জবাব দিয়েছিলেন, 'দেহ ব্যবসা করি'
মৎস্য ভবনের সামনে থেকে শাহবাগের দিকে চলে গেছে যে রাস্তাটি সেখানে ফুটপাতের এক অন্ধকার অংশে দাঁড়িয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন চার জন মহিলা।
সবাই সেজেগুজে রয়েছেন।
এদের মধ্যে একজন বয়স্ক, সম্ভবত তিনিই দলটির নেতা।
কি করেন? জানতে চাইলে নিঃসঙ্কোচ জবাব, 'দেহ ব্যবসা করি'।
পাশেই এক টুকরো পলিথিন দিয়ে ছোট্ট তাঁবুর মত।
জানালেন এটাই তার 'অফিস'।
ত্রিশ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই পথে।
বৃষ্টি হলে ছোট্ট তাঁবুর ভেতরে গুটিসুটি পাকিয়ে বসে থাকেন।
দিনের বেলায় ঘুমান রমনা পার্কের বেঞ্চিতে।
রাতের বেলা মাঝে মাঝে এসে তাদেরকে মারধর করে চলে যায় অচেনা যুবকের দল।
মাঝে মাঝে ভেঙ্গে দেয় তাদের রাতের 'অফিস'।
পরের রাতে আবার ব্যথা ভুলে নতুন করে 'অফিস' খুলে জীবীকার সন্ধানে নেমে পড়ে এই ভাসমান যৌন কর্মীদের দলটি।
তিন নেতার মাজারের সামনে ফুটপাতে বসে নিবিষ্ট মনে কোরান পাঠ করছেন শাহনাজ বেগম।
ঘুরতে ঘুরতে আপনি এমনও মানুষকে পেয়ে যেতে পারেন, যিনি সড়ক বাতির আলোয় বসে নিবিষ্টমনে পাঠ করছেন কোরান।
দোয়েল চত্বর সংলগ্ন তিন নেতার মাজারের সামনে এমনই একজনের দেখা মেলে।
ফুটপাতে সড়ক বাতির আলোয় কোরান পাঠ করছিলেন চট্টগ্রাম থেকে আসা স্বামী-সন্তানহারা গৃহহীন প্রৌঢ়া শাহনাজ বেগম।
জীবনটাই তার কাটছে মাজারে মাজারে কোরান পাঠ করে।
ভাল রোজগার, তারপরেও গৃহহীন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের সামনে যেখানটি দিয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ঢোকার ফটক, সেখানে সারি সারি অনেকগুলো ভ্যানগাড়ি।
দিনের বেলায়, এই গাড়িগুলো চটপটি-ফুচকার দোকান।
রাত্রি বেলায় প্রতিটি এক একটি আবাসিক ভবন।
একটি ভ্যানের ওপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
তিনি দিনের বেলায় একটি ডেকোরেটরের দোকানে শ্রমিকের কাজ করেন।
তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে, তারা গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
গ্রামে মি. হোসেনের একটি ঘরও আছে, কিন্তু সেখানে উপার্জনের উপায় নেই বলে এভাবে রাজধানীতে থাকা।
কিন্তু যা রোজগার করেন, তা দিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকতে গেলে বাড়িতে কিছু পাঠাতে পারেন না।
তাই খোলা আকাশের নিচেই রাত পার করেন তিনি।
এভাবেই চলছে ছ-সাত বছর ধরে।
চাঁদপুরের আবুল হোসেন। দিনে চায়ের দোকানে চাকরি করেন, রাতে চটপটির দোকানে ঘুমান। এভাবেই তার কেটে গেছে ২৫ বছর।
'শহুরে দারিদ্র' নিয়ে গবেষণা করছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
তিনি বলছেন, ঢাকায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আসে ভাল রোজগারের আশায়, তারা টাকার হিসেবে গ্রামের তুলনায় ভাল রোজগারও করে, কিন্তু সেই রোজগারও দেখা যায় বস্তি নামের হত দরিদ্রদের বাসস্থানে তাদের একটু ঠাঁই জুটিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট নয়।
গৃহহীনদের সংখ্যা কত?
ঢাকায় খোলা আকাশের নিচে কি পরিমাণ মানুষ বসবাস করছে, তার স্পষ্ট কোন হিসেব নেই।
তবে গত আট বছর ধরে শহুরে ছিন্নমূলদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন সাজিদা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র উপদেষ্টা ডক্টর শমসের আলী খান বলছেন, তাদের হিসেবে কুড়ি হাজারের মত মানুষ রয়েছে ঢাকায়, যাদের একেবারেই ঘরবাড়ি কিছু নেই।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ দু-তিন প্রজন্মও কাটিয়ে দিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
অনেকেরই জন্ম হয়েছে ফুটপাতে, মৃত্যুও সেখানে।
সাজিদা ফাউন্ডেশন মূলত এসব মানুষের জীবনমান ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
তারা ঢাকার ৫টি স্থানে, যেখানে এমন ছিন্নমূল মানুষের দেখ বেশী মেলে সেখানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
কারওয়ান বাজারের এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্র এক বিকেল বেলা আমি গিয়ে দেখতে পাই বেশ কয়েকটি শিশু একটি কামরার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।
এটি এই সংস্থাটির একটি শিশু দিবা যত্ন কেন্দ্র।
ঢাকার বারো হাজারের মত ছিন্নমূল মানুষ এই সংস্থাটির অধীনে রয়েছে।
ড. খান বলছেন, আশ্রয়হীনদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি বিগত বছরগুলোতে ঢাকায় পথবাসী মানুষের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে দেখেছেন।
হাইকোর্টের সামনে বহু গৃহহীনের ভিড়ে পাওয়া গেল এক দম্পতিকেও।
কিন্তু এই সংস্থাটির কর্ম এলাকার বাইরে রয়ে গেছে হাইকোর্ট মাজার চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশ,গুলিস্তানের মত বহু এলাকা, যেসব এলাকায় ঘুরে ঘুরে আমি বহু মানুষকে ফুটপাতে ঘুমাতে দেখেছি।
মধ্যরাতে কার্জন হলের উল্টোদিকে হাইকোর্টের যে ফটকটি, সেখানে গিয়ে দেখতে পাই সারি সারি কাঠের বাক্স,তলায় ছোট ছোট চাকা লাগানো।
দিনের বেলায় এমন সব চাকা লাগানো বাক্সে চড়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় বহু প্রতিবন্ধীকে।
রাতের বেলা সেই বাক্সে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন তারা।
হাইকোর্টের দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতে গোল হয়ে বসে আরেক দল।
সেখান থেকে ভেসে আসছে গাঁজার উৎকট গন্ধ।
আশপাশে কি ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে মোটেও সচেতন নন।
রাতভর ঘুরে ঢাকার রাস্তায় এরকম বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।
রাত বাড়ার সাথে সাথে শহর নিস্তব্ধ হতে থাকে, পথ চলতি মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে, শুধু বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ে ফুটপাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা ঘরহীন মানুষদের।
কেউবা দিনভর কাজ করে শ্রান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কেউবা মাদকাসক্ত। ফুটপাতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন নেশার ঘোরে।
প্রধান খবর
চিঠিপত্র ও মতামত
এডিটার'স মেইলবক্স: আল জাজিরা নিয়ে 'একপেশে' আর চীন-ভারত নিয়ে দ্বিচারিতা?
বাংলাদেশে আল জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে আলাপ-আলোচনার মনে হচ্ছে কোন শেষ নাই।