২০১৬ সালের আলোচিত ব্যক্তি
২০১৬ সাল ছিল এক ঘটনাবহুল, আলোচিত বছর। তবে ঘটনার পাশাপাশি এই বছরে সারা পৃথিবীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ক’জন ব্যক্তি।
তারা ঘটনা ঘটিয়েছেন, সারা পৃথিবীর মানুষ প্রতিদিন তাদের নীতি ও কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক করেছেন। এমনকি আগামী বছরে যা ঘটবে - তার ওপরও গভীর এবং সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছেন তারা।
এমন ছয় জন সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিকে নিয়েই বর্ষ পরিক্রমার এই পর্ব।
এ অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালের আলোচিত ছয় ব্যক্তিত্বের ভূমিকা ও প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সির্টির সরকার ও রাজনীতির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এবং লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক খান।
২০১৬-র সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হিসেবে অনেকের বিবেচনাতেই হয়তো প্রথম যার নাম আসবে - তিনি আমেরিকার ভাবী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প - যাকে ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনও 'পার্সন অব দি ইয়ার' মনোনীত করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর এই উত্থান সবাইকেই অবাক করেছে, কারণ মার্কিন রাজনীতিতে এমন বিস্ময়কর নির্বাচন কখনো হয় নি।
কিন্তু এর কারণ কি? অধ্যাপক আলি রীয়াজ বলছিলেন, মি. ট্রাম্প আসলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন প্রবণতার প্রতীক।
ছবির উৎস, Drew Angerer
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যাকে ইতিমধ্যেই টাইম ম্যাগাজিনও পার্সন অব দি ইয়ার মনোনীত করেছে।
ড: আলী রীয়াজের মতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতির তিনটি প্রবণতার প্রতিফলন পড়েছে।
"একটি হলো উগ্র জাতীয়তাবাদ - যা পৃথিবীর নানা দেশে দেখা যাচ্ছে। আরেকটি হচ্ছে 'পপুলিজম' বা যাকে বলা যায় 'লোকরঞ্জনবাদ', আর তৃতীয়টি হচ্ছে কর্তৃত্বপরায়ণতা বা অথরিটারিয়ানিজম - এবং বলতে গেলে এই তিনের সমন্বয়ে বিশ্বে গণতন্ত্রের রাজনীতিতেই এখন একটা উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে - যার একটি দৃষ্টান্ত ট্রাম্প" - বলছেন ড. রীয়াজ।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলছেন - এবং যা শুনে আমেরিকানরা তাকে ভোট দিয়েছে, তা কি সত্যি বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব?
অর্থনীতিবিদ ড. মুশতাক খান বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের অনেকেই বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও মুক্ত বাজার ব্যবস্থার কারণে লাভবান হতে পারে নি। যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পখাতে লোকেরা চাকরি হারাচ্ছে - যা চলে যাচ্ছে চীনের মতো এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
"অনেকে সেবা খাতে সস্তা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে - কিন্তু সেখানে আবার অভিবাসীদের সাথে তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এই ক্ষোভ তাদেরকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনীতিবিদদের দিকে ফিরিয়েছে।"
ড. খান বলেন, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিবাসীদের বের করে দিয়ে বা চীনের সাথে বাণিজ্য চুক্তি উল্টে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করবেন বলছেন - তা আসলে আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
ছবির উৎস, AFP
ড. আলী রীয়াজের মতে পুটিন বিশেষ করে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতার সমীকরণ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
একটা সময় ছিল স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বেশ কিছুকাল এমন একটা সময় ছিল যে রুশ-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা অনেক কমে গিয়েছিল।
কিন্তু গত কয়েক বছরে এই রেষারেষি বেড়েছে এবং সবশেষ সিরিয়ায় রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরুকে কেন্দ্র করে তা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। মনে হচ্ছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন যেন বারাক ওবামাকে পাশে ঠেলে দিয়ে নিজেকে পরিণত করেছেন বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের এক নতুন নিয়ন্তা হিসেবে।
ড. আলী রীয়াজের মতে মি. পুটিন বিশেষ করে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতার সমীকরণ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও কি সে রেষারেষি আরো বাড়বে? এ হিসেবটা অনেকের চোখেই একটু জটিল - কারণ মি. ট্রাম্প ও মি. পুটিন পরস্পরের সম্পর্ক যেসব কথা বলেছেন তাতে মনে হতে পারে যে তারা পরস্পরকে কোন কোন দিক থেকে পছন্দই করেন।
এক হিসেবে এ বছরের আলোচিত চরিত্রদের অনেকেই ছিলেন পরস্পরের সংগে কোন না কোন কার্যকারণে সম্পর্কিত।
২০১৬র আলোচিত ঘটনা ছিল ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে গণভোটের রায়।
ছবির উৎস, AFP
ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোটের রায় বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল
ব্রেক্সিটের পক্ষের ভোটাররা মনে করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্রিটিশদের চাকরি কেড়ে নিয়েছে - ব্রিটেনে ইউরোপের অভিবাসীরা বানের জলের মতো ঢুকে পড়ে তাদের সব চাকরিবাকরি নিয়ে নিয়েছে - ব্রিটেনকে ব্রাসেলসের আমলাদের অধীন দেশে পরিণত করেছে।
অভিবাসনবিরোধী এই প্রচারণা চালিয়ে সারা ইউরোপের ডানপন্থীদের তো বটেই - এমনকি আমেরিকার ট্রাম্প শিবিরেরও মনোযোগ কাড়েন ব্রিটিশ দক্ষিণপন্থী দল ইউকে ইনডিপেন্ডেন্স পার্টি বা ইউকিপের নাইজেল ফারাজ ।
ব্রেক্সিটের অভিঘাত শুধু ব্রিটেনে সীমাবদ্ধ থাকে নি, তার গভীর প্রভাব পড়েছে ইউরোপের রাজনীতিতে এবং মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণাতেও।
ডোনাল্ড ট্রাম্প - যিনি নিজেও আমেরিকায় মেক্সিকান, হিস্পানিক ও মুসলিম অভিবাসনের তীব্র বিরোধী, যিনি আমেরিকানদের চাকরি হারানোর জন্য চীন এবং বিশ্বায়নকে দায়ী করেন - তিনি মনে করেছেন, নাইজেল ফারাজ তার এজেন্ডাকেই ভাষা দিয়েছেন। মি. ফারাজকে তার প্রচারণাসভাতে বক্তৃতা দেয়াতেও নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
ছবির উৎস, Getty Images
নাইজেল ফারাজ
বছরের আরেক আলোচিত চরিত্র জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেল ছিলেন একেবারে অন্য মেরুতে ।
গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ সিরিয়া ও ইরাকসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে থেকে অভিবাসীরা যখন দলে দলে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসছে - তখন আঙ্গেলা মার্কেল তার দেশের দরজা খুলে দেন প্রায় ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীর জন্য।
এর জন্য একদিকে উদারপন্থীদের মধ্যে তিনি যেমন হয়েছেন নন্দিত, অন্য দিকে এর প্রতিক্রিয়াতে ইউরোপের ব্রিটেন ও ফ্রান্স থেকে শুরু করে অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডস সহ বিভিন্ন দেশে তৈরি হয় তীব্র অভিবাসন বিরোধী মনোভাব ।
এই বিরোধীরা নাইজেল ফারাজের মতো রাজনীতিবিদ এবং ব্রেক্সিট দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এসব দেশে নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণপন্থী অভিবাসনবিরোধী রাজনীতির প্রভাব দিনকে দিন তীব্র হচ্ছে - যা হয়তো ২০১৭-তে আরো স্পষ্ট হবে।
এমনকি আঙ্গেলা মারকেল নিজেও জার্মানিতে আরেকটি নির্বাচন জিততে পারবেন কিনা - সেই সংশয়ও তৈরি হয়েছে।
ছবির উৎস, AP
গত বছর জার্মানি রেকর্ড সংখ্যক শরণার্থী নেয় যা নিয়ে তোপের মুখে পড়েছিলেন আঙ্গেলা মার্কেল
অধ্যাপক ড. মুশতাক খানের মত হলো, ইউরোপে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে - তাতে আঙ্গেলা মার্কেলের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সত্যি অনিশ্চিত।
ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের ঠিক মাঝখানের দেশ তুরস্ক।
সিরিয়া থেকে অভিবাসীরা আসছে তুরস্কের ভেতর দিয়ে, আবার সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের পশ্চিমা জোটের ঘাঁটিও তুরস্কে। তুরস্ক নেটোর সদস্য, তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হবার প্রক্রিয়ার মধ্যেও আছে।
তাই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরদোয়ান যে বছরের আলোচিত ব্যক্তিদের অন্যতম হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি?
ভেতরে বাইরে নানা সংকটে তুরস্ক যখন ব্যতিব্যস্ত, তখনই এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান এবং তার পর মি. এরদোয়ান যেভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা স্তরে তার রাজনৈতিক শত্রুদের শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন তা নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
নির্বাচত প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি ক্রমশই একনায়ক এবং স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন?
ড. মুশতাক খানের মতে, একসময় গণতান্ত্রিক নেতা বলে পরিচিত হলেও এখন মি. এরদোয়ানের মধ্যে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা সত্যি দু:খজনক।
ছবির উৎস, Getty Images
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল
ড. আলী রীয়াজ বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো পপুলিস্ট-দক্ষিণপন্থী-কর্তৃত্ববাদী অনেক নেতার উত্থান ঘটেছে সাম্প্রতিক বিশ্বে - যার মধ্যে ভারতের নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে অনেকেই আছেন।
এই রাজনীতিবিদদের মধ্যে - মিসেস মার্কেল ছাড়া - কিছু সা্দৃশ্য হয়তো অনেকেরই চোখ এড়াবে না। এরা সবাই জনপ্রিয় পপুলিস্ট নেতা, সবাই কঠোর শাসক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চান, এবং এরা অভিবাসন ও উদারনৈতিক রাজনীতির বিরোধী।
এর একটি চরম বা একট্রিম উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফিলিপিন্সএর প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতের্তের কথা। তার কথা খুবই সহজ সরল, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অর্থ তার কাছে মাদক-ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে হত্যা করা, আর মাদকসেবীদের জেলে ভরা।
তিনি চান ফিলিপিন্স থেকে মার্কিন প্রভাব দূর করতে। প্রেসিডেন্ট ওবামাও তার গালিগালাজের হাত থেকে রেহাই পান নি। কিন্তু ফিলিপিন্সে মি. দুতের্তের জনপ্রিয়তা এখনো ৭০ শতাংশ।
এমন নেতারা কেন মানুষের প্রিয় হচ্ছেন আজকাল?
ড. আলী রীয়াজ এবং ড. মুশতাক খানের মতে এটা এক বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ ।
এ ধরণের নেতাদের প্রাধান্য ২০১৭ সালেও মোটামুটি অব্যাহত থাকবে বলেই তারা মনে করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, পুটিন, এরদোয়ান, দুতের্তে-র মতো নেতারা এবং তাদের বিশ্বায়নবিরোধী অভিবাসনবিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনীতিই যদি ২০১৭ সালে জোরদার হয়ে ওঠে তাহলে বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও হয়তো আমরা এক নতুন এবং গুণগত পরিবর্তন দেখতে পাবো।