দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: সোভিয়েত বোমারু বিমানের এক নারী পাইলটের রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: সোভিয়েত বোমারু বিমানের এক নারী পাইলটের রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বিমান বাহিনীতে বোমারু বিমানের এক নারী পাইলট ছিলেন ইয়েলেনা মালুচিনা। তিনি এবং তার কমরেডরা তখন ছিলেন বিশ্বের একমাত্র নারী পাইলট যারা যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান চালিয়েছেন।

তখন ১৯৪৪ সালের জুলাই মাস। রাশিয়ার রেড আর্মি বেলারুসিয়ার দিকে এগোচ্ছে এবং নাৎসী বাহিনীকে সোভিয়েত এলাকা থেকে হঠিয়ে দিচ্ছে। তারিখটা ছিল চৌঠা জুলাই - পাইলট ইয়েলেনা মালুচিনা এবং তার সহকর্মীরা বসেছিলেন নির্দেশের অপেক্ষায়।

"সকালে আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। আমরা ভাবলাম সেদিন আমাদের বিমান নিয়ে উড়তে হবে না। বিমানের ঠিক নিচেই বসে আছি- আদেশের অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখলাম একটা সাদা রকেট- ওটাই আমাদের ওড়ার নির্দেশ।"

তারা বিমান নিয়ে আকাশে উড়লেন এবং চললেন তাদের লক্ষ্যবস্তুর দিকে। তাদের লক্ষ্য ছিল লিথুয়ানিয়ার একটা প্রধান রেল জাংশান। পেছু হঠতে থাকা জার্মানরা সেখানে তাদের সামরিক সরঞ্জাম রাখত। যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে ওটাই ছিল তাদের শেষ রণাঙ্গন আর ওই স্টেশনে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম মজুত রেখেছিল তারা ।

''তাই আমরা প্রায় ১৮০টি বিমানের বহর নিয়ে রওনা দিলাম। আমাদের বিমানক্ষেত্র ছিল মাটির- বোমা ভরা বিমান নিয়ে এতগুলো বিমান সেখান থেকে একসঙ্গে টেক-অফ করা সহজ কাজ ছিল না। তবুও আমরা পর্যায়ক্রমে বিমান নিয়ে আকাশে উড়লাম।"

ইয়েলেনা মালুচিনার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন লেখিকা লুবা ভিনোগ্রাদোভা ডিফেন্ডিং দ্য মাদারল্যান্ড- নামে তার বইয়ে।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

জার্মানির বার্লিন শহরের উপর রুশ বোমারু বিমান: ১৯৪৫ সাল

তিনি বলেছেন ইয়েলেনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল যখন ইয়েলেনার বয়স ৯২।

''তার যে অত বয়স তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। শারীরিকভাবে তিনি শক্ত ছিলেন আর মানুষ হিসাবেও খুব আন্তরিক ছিলেন। উষ্ণ ও বন্ধুবৎসল। নানা বিষয়ে গল্প করতে ভালবাসতেন, প্রিয় কবিতা আওড়াতেন- ওই বয়সেও দারুণ স্মরণশক্তি ছিল।'' বলেছেন লুবা ভিনোগ্রাদোভা।

ইয়েলেনা বিমান চালানোর দিকে ঝোঁকেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে যখন তার শহর লেনিনগ্রাডের একটা বিমান ক্লাবে তিনি যোগ দেন। তিনি যখন মাধ্যমিক স্কুল শেষ করেন তখন তিনি পুরো প্রশিক্ষিত বেসামরিক বিমানের পাইলট।

এটা হয়ত ব্যতিক্রমী নয়, কিন্তু অবশ্যই অসাধারণ।

১৯৩৭ সালে তিনি খোলা বিমানে চিঠি বিলির কাজ নেন- যেটা ছিল তার প্রথম চাকরি। পরে তিনি বিমানচালনার প্রশিক্ষক হন। এর পরের বছর কিংবদন্তী সোভিয়েত নারী বিমানচালক মারিনা রাস্কোভা বিমান নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম অঞ্চল থেকে দূর প্রাচ্যে মাত্র ২৪ ঘন্টার কিছু বেশি সময়ে পৌঁছে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। রাস্কোভার আহ্বানে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েক হাজার তরুণী তখন এই পেশায় যোগ দিয়েছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর মারিনা রাস্কোভা বিমানবাহিনীতে তিনটি নারী রেজিমেন্ট গঠন করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তার রেজিমেন্টের নারী বোমারু বিমান পাইলটদের সোভিয়েট বিমান বাহিনীর ভারী বোমাবর্ষণকারী সর্বাধুনিক বিমান চালানোয় দক্ষতা অর্জন করতে হয়।

পিই টু নামে বিশেষ ওই বিমান সময়ের হিসাবে খুবই আধুনিক ছিল। সেসময়ের অন্য বিমানের তুলনায় খুব দ্রুতও ছিল ওই বিমানের গতি। কাজেই অবতরণের সময় খুবই সতর্কতা নিতে হাতো।

বিমানগুলো যখন মিশনে যেত তখন সেগুলো খুব ঝুঁকির মুখে থাকত। অনেক ওজনের বোমা থাকত বিমানগুলোয়- প্রায় এক টনের মত। কাজেই বিমানগুলো খুশিমত চালানো যেত না।

ইয়েলেনা রণাঙ্গনে বিমান হামলা চালানো শুরু করেন ১৯৪৪ সালে। বেসামরিক বিমান চালানোয় তার বেশ অনেক বছরের অভিজ্ঞতা ছিল। সেই অর্থে তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ পাইলট।

কিন্তু চৌঠা জুলাই ভাগ্য তার পক্ষে ছিল না। যখন লক্ষ্যের কাছে বিমান নিয়ে তারা পৌঁছেছেন, তখন আবহাওয়া বেশ খারাপ হয়েছে। তাদের সামনের বিমান বোমাহামলার মিশন শেষ করে ফিরে গেছে। তাদের নয়টি বিমান তখনও আকাশে। লক্ষ্যবস্তুর ওপর আকাশে চক্কর দিতে হবে এবং মাটির ওপর ৮০০ মিটার পর্যন্ত নেমে বোমা ফেলতে হবে।

''সাধারণত আমরা এক থেকে দেড় হাজার- কখনও কখনও দুহাজার মিটার উপর থেকে বোমা ফেলতে অভ্যস্ত। কিন্তু এবার সেটা হচ্ছে না। যাহোক্ - বিমানের হ্যাচ খুলে আমরা বোমা তো ফেললাম।''

ঠিক ওই মুহূর্তেই জার্মান বিমানবিধ্বংসী একটা গোলা আঘাত করে ইয়েলেনাকে এবং তিনি গুরুতরভাবে জখম হন।

''প্রথমে মনে হচ্ছিল পুড়ে গেছি। পরে শুধুই দুর্বল বোধ করছিলাম। আসলে ভেতরে আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল - আমি বুঝতে পারিনি। গোলাটা প্রথম এসে লেগেছিল প্লেনের প্রপলারে- পরে সেটা আমার শরীরে আঘাত করে- তাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম।''

ছবির উৎস, B. Kudoyarov/Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

যুদ্ধবিধ্বস্ত লেনিনগ্রাদ (১৯৪৩)

ইয়েলেনার আঘাত খুবই গুরুতর ছিল। পরে জানা যায় গোলার ১৫টি টুকরো তার অন্ত্রে ঢুকে গিয়েছিল।

হাসপাতালে সব ব্যবস্থাই ছিল পুরুষদের জন্য। যেমনটা ইয়েলেনা দেখেছেন তার কর্মজীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে।

লুবা বলছিলেন মেয়েদের জন্য জীবন সবক্ষেত্রে কঠিন ছিল। বিমানক্ষেত্রে কোনো টয়লেট ছিল না, পাছে টয়লেটের প্রয়োজন হয় তাই ইয়েলেনা তরল কিছুই খেতেন না।

''প্রথমদিকে তো মেয়েদের জন্য আলাদা ইউনিফর্মও ছিল না। ১৯৪১এর অক্টোবরে যেসব মেয়ে কাজে যোগ দিয়েছিল, তাদের পুরুষের ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছিল। যারা একটু বেঁটেখাটো তাদের ওই ইউনিফর্ম ঢলঢলে হতো। পরে সেগুলো কেটেছেঁটে মেয়েদের উপযোগী করা হয়েছিল। পুরুষদের অর্ন্তবাসও মেয়েদের পরতে দেওয়া হতো। অবশ্য মেয়েরা হাতের কাছে যেসব কাপড় পেত তাই দিয়ে নিজেদের অর্ন্তবাস বানিয়ে নিত। তাদের খুব প ছন্দের ছিল জার্মান প্যারাসুটের সাদা সিল্কের কাপড়।''

দুমাস সেনা হাসপাতালে কাটানোর পর চিকিৎসকরা পাইলট ইয়েলেনা মালুচিনাকে সেরে ওঠার জন্য আরও একমাস স্বাস্থ্যনিবাসে কাটানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু ইয়েলেনা তাতে রাজি হন নি।

ইয়েলেনার মনে হয়েছিল হাসপাতালে দুমাসই যথেষ্ট। তিনি বেসামরিক বিমানের সাহায্য নিয়ে তার নিজের বিমানক্ষেত্রে নিজের রেজিমেন্টে ফিরে যান।

বিমানের পাইলট হিসাবে তাদের দক্ষতা প্রমাণ করার এটাই ছিল সবচেয়ে বড় সুযোগ। সেটাই ছিল তখন এই নারী পাইলটদের জন্য সবকিছুর উপরে।

১৯৪৫ সালে নারী পাইলটদের নিয়ে একটি সোভিয়েত চলচ্চিত্র খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

ইয়েলেনা ২০১৪ সালে ৯৮বছর বয়সে মারা যান।

ইতিহাসের সাক্ষী পরিবেশন করেছেন মানসী বড়ুয়া।