বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলা ক্যানাডার আদালতে খারিজ
- সায়েদুল ইসলাম
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস, AFP
ক্যানাডার কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাওয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণে যে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে অনেক বিতর্ক হয়েছে, ক্যানাডার একটি আদালত সেই দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা এক মামলা খারিজ করে দিয়েছে।
ক্যানাডার একটি কোম্পানি এসএনসি- লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করা হয়েছিল। আর এই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে তাদের ঋণ বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই যে ওই অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা এই রায়ে প্রমাণিত হলো।
পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ক্যানাডার আদালত বলছে, এই মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা অনুমান ভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি সহ পুরো মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক নিজেরা তদন্ত শুরু করে এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই তারা ক্যানাডা পুলিশকে সেদেশের এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের তদারকি কাজ পাওয়ার জন্য শর্ট লিস্টে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। যদিও তারা এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন।
পদ্মার সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে অনেক বিতর্ক হয়েছে
দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন আর তখনকার সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পাশাপাশি তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
পরে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের পর তাদের সবাইকেই অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মি. ভূঁইয়া বলছিলেন ক্যানাডার আদালতের এই রায়ের ফলে তাদের দুর্নীতিহীনতার বিষয়টি আবার প্রমাণিত হলো।
বর্তমানে আরেকটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলছেন, "ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।"
"প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অনেকের মধ্যে একটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল যে, হয়তো কোন ষড়যন্ত্র হতেও পারে। আবার অনেকে বলতো, দুদক হয়তো তাদের সরকারের কথা মতো ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি যতটুকু জেনেছি, ক্যানাডার কোর্ট হাজার হাজার কাগজ দেখে, তথ্য প্রমাণ দেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখেই এই রায়টি দিয়েছে। তার মানেই, বিশ্বব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে অভিযোগটি করেছে, যা তাদের ইতিহাসেও বিরল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আমাদের বাংলাদেশেরই জয় হয়েছে। এর ফলে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, আমাদের সকলের বিজয় হয়েছে।"
দুর্নীতির এই অভিযোগ নিয়েই টানাপোড়েনের জের ধরে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। পরে নিজস্ব অর্থায়নেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে।
সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। যদিও গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ক্যানাডার আদালতের এই রায়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে এটা শুধু মিথ্যা নয়, ষড়যন্ত্রমূলক ছিল।
ছবির উৎস, Facebook
প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদের প্রতিক্রিয়া তার ফেসবুক পাতায়
একই অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, এই রায়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে, এটি ছিল বিশ্বব্যাংকের একটি সাজানো অভিযোগ।
তিনি লিখেছেন মোহাম্মদ ইউনুসের পরামর্শে আর হিলারি ক্লিনটনের নির্দেশে বিশ্বব্যাংক একটি সাজানো অভিযোগ তুলে, আওয়ামী সরকারকে শাস্তি দেয়ার জন্যই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে। তিনি মনে করেন, যারা এসব অভিযোগ আমলে নিয়েছেন, তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, অনেক দুর্নীতির অভিযোগই শেষপর্যন্ত আদালতে প্রমাণিত হয়না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, যা একেবারেই নজিরবিহীন।
মি. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, "এই কোম্পানিটি, এসএনসি লাভালিন, তাদের রেকর্ড খুব ভালো না। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি ওঠা খুব স্বাভাবিক যে, আদালত যে এই রায় দিলো, সেটা কতটুকু তথ্যের ঘাটতির কারণে আর কতটুকু দুর্নীতি না হওয়ার কারণে। তবে যে শব্দগুলো আদালত ব্যবহার করেছে, তা গুরুত্ব বহন করে। আদালত বলেছে, বিষয়গুলো জল্পনা, গুজব এবং রটানো গল্প নির্ভর অভিযোগ। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই পৃথিবীর কোথাও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যা করেছে, অভিযোগটি উত্থাপিত করেছে, পাশাপাশি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তারা বাংলাদেশকে তাদের অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত করেছে। কেন তারা সেটা করেছে, সেটা বাংলাদেশ সরকার জানতে চাইতে পারে। এবং সেখানে এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য কোন উপাদান কাজ করেছে কীনা, সরকারের উচিত হবে সংক্ষুব্ধ পার্টি হিসাবে সেটা তাদের কাছে জানতে চাওয়া।"
তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্যানাডার আদালতের এই রায়ে সংস্থাটি তাদের ভুল উপলব্ধি করতে পারবে বলে তারা আশা করছেন।