'গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান আমার চোখের সামনেই'
- সাইয়েদা আক্তার
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন
"একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গুলিববিদ্ধ তিনজনকে হাসপাতালে গ্রহণ করি আমি। কপালে গুলিবিদ্ধ রফিককে দেখেই মৃত ঘোষণা করা হয়, আর উরুতে গুলিবিদ্ধ বরকত মারা যান রাতে, আমার চোখের সামনেই।"
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বলছিলেন ডাক্তার মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। ১৯৫২ সালের সেই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ছিলেন তিনি।
এখন তিনি সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন। ইতিহাসের সেই ক্ষণের সাক্ষী ভাষাসৈনিক মি. হোসেনের বয়স এখন প্রায় ৯০।
ঐদিন দুপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা মূমুর্ষ রোগীদের নিয়ে আসা হয় জরুরী বিভাগে। এদের মধ্যে অন্তত দু'জনকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছেন তিনি। আহত আরো অনেককে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি।
"আমরা তখন বাইরে থেকে বহু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা শুনেছিলাম বহু মানুষ গুলিতে আহত হয়েছে।"
তিনি বলছিলেন, দুপুরে তার ডিউটিতে যাবার সময়টাতেই পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং পুলিশ মিছিলে গুলি ছোঁড়ে।"
"মুহুর্তেই এমারজেন্সী ওয়ার্ড পূর্ণ হয়ে যায়। আহতদের অনেকেই মুমুর্ষু, তাদের সঙ্গে আসা মানুষজন আর চিকিৎসকে ঠাসাঠাসি হয়ে যায় জরুরী বিভাগ।
ডাক্তার মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেনের বই
নিজের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ 'আমার জীবনের সত্তর বছর'-এ মি. হোসেন উল্লেখ করেছেন, গুলিবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে মোহাম্মদ রফিককে মৃত অবস্থাতেই আনা হয়েছিল জরুরী বিভাগে।
কপালে গুলির ক্ষত নিয়ে আসা রফিককে দেখার পরই চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাম উরুতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এরপর আনা হয় আবুল বরকতকে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাতে মি. হোসেনের চোখের সামনেই মারা যান বরকত।
আর পেটের উপরে গুলির জখম নিয়ে আনা হয়েছিল সালামকে। একমাস পরে মারা গিয়েছিলেন সালাম।
সেই ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন মি. হোসেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডা. মুহাম্মদ মাহফুজ হোসেন সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন ৪২ বছর। বছর কুড়ি আগে অবসর নিয়ে বেসরকারীভাবে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছিলেন নিজের ক্লিনিকে।
দেড় বছর আগে ব্রেইন-স্ট্রোক করে হাঁটাচলার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন, কথাবার্তাও অনেক সময় জড়িয়ে যায়। এখন গুলশানে নিজের বাড়িতে মোটামুটি নিভৃত জীবন যাপন করছেন।
পেপার পড়া কিংবা টিভি অনুষ্ঠান তেমন টানে না তাকে। পরিবারের সদস্যরা জানালেন কারো সঙ্গেই তেমন একটা কথাবার্তা বলতে চান না আজকাল। সাক্ষাৎকারও দিতে চান না।
তবে, একুশে ফেব্রুয়ারির দিনের কথা জানতে চাই শোনার পর, কথা বলতে রাজি হলেন।
জানালেন ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির সকাল থেকে হোস্টেলে নিজের ঘর থেকেই বাইরের উত্তেজনা টের পাচ্ছিলেন।
"আগে থেকেই ডাক ছিল ঐদিন ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল করবে। মূলত মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের বিক্ষোভ হবার কথা থাকলেও, সারা শহর থেকেই ছাত্ররা আসে সেখানে।"
এর কিছুদিন আগে মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের সবে দায়িত্ব বন্টন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ২১ শে ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে এমারেজেন্সী ওয়ার্ডে দায়িত্ব ছিল মি. হোসেন এবং তার আরো দুই সহপাঠীর।
সেখানেই দায়িত্বপালনকারী ছাত্র দলটির নেতা হিসেবে জরুরী বিভাগে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে গ্রহণ করেন মি. হোসেন।
"দুপুর দুইটার দিকে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে আমি গ্রহন করি। এরপর আমাদের প্রফেসররা দেখেন। তিনজন বিদেশী প্রফেসর ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ তখন নতুন ছিল, চিকিৎসকের ঘাটতিও ছিল।"
তবে, আহতদের চিকিৎসা দেবার ক্ষেত্রে কোন রকম বাধার সম্মুখীন হননি বলে জানিয়েছেন মি. হোসেন।
"বাইরের সবকিছু দেখতে তো পাইনি। তবে, এমারজেন্সী ভরে গিয়েছিল মানুষে। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছিল দেখেছি। মানুষের জন্য মানুষের জীবন দেবার উৎসাহ দেখেছিলাম সেদিন।"