বাংলাদেশে একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের জীবন কতটা চ্যালেঞ্জের?
- ফারহানা পারভীন
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস, BBC Bangla
রেহানার বয়স তখন মাত্র ছয়। সেই শিশু বয়স থেকে বাবা-মাকে ছেড়ে তার একলা পথ চলা।( ফাইল ফটো)
ঢাকার নিলক্ষেতের একটি ছাত্রী হোস্টেলে থাকেন রেহানা আকতার।
টেলিফোনে কথামতো হোস্টেলের নির্দিষ্ট স্থানে দাড়িয়ে ছিলো সে। প্রথম দেখায় ধারনা করা যাবে না রেহানা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। পাঁচ ভাই বোনের সবার ছোট সে। বাড়ি ভোলা।
ভাই-বোনের কারো কোন প্রতিবন্ধিতা না থাকলেও রেহানাকে নিয়ে গভীর সমস্যায় পড়েন তারা বাবা-মা। সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকায় দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করবেন।
রেহানার বয়স তখন মাত্র ছয়। সেই শিশু বয়স থেকে বাবা-মাকে ছেড়ে তার একলা পথ চলা।
এর পর নানা সংগ্রাম, কখনো নিজের সাথে, কখনো পরিবারের সাথে, কখনো আশেপাশের মানুষের সাথে।
ঢাকার একটি কলেজে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অপেক্ষা একটা চাকরি এবং বিয়ে করে সংসার জীবনের। কিন্তু সেখানেও সংগ্রাম আর একরাশ হতাশা।
তিনি বলছিলেন "সবার স্বপ্ন থাকে বিয়ে করে সংসার করা, কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী ছেলে বিয়ে করতে পারলেও একটা প্রতিবন্ধী মেয়েকে কে বিয়ে করবে?"
রেহানার সাথে কথা শেষে আমার গন্তব্য ঢাকার শেখেরটেক এলাকায় সুমনার বাসা। দুই রুমের এই বাসায় এক কামরায় কাটে তার সারাটা সময়।
সুমনা শারিরীক প্রতিবন্ধী। জন্মগতভাবে দুই হাতের কবজির অংশটি নেই। তাছাড়া একটি পায়ে চলাচলের ক্ষমতাও তার নেই।
শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সুমনার কাছে প্রধান সমস্যা মনে হয়েছে ইচ্ছেমত বাইরে বের হতে না পারা।
ঢাকার বাইরে বেশি সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় মেয়েদের
তিনি বলছিলেন মেয়ে প্রতিবন্ধি হওয়ার ফলে পরিবারের একেবারে আপন জন ছাড়া বের হতে পারেন না।
ছেলে হলে এতটা সমস্যা হতো না। তিনি মূলত মেয়ে হিসেবে হয়রানির প্রসঙ্গটিকেই ইঙ্গিত করলেন।
ঢাকার বাইরে বেশি সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় মেয়েদের
বাংলাদেশের শহরে এবং গ্রামে এমন অসংখ্যা মেয়ে রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধরণের শারিরিক প্রতিবন্ধী।
তবে বড় শহরের তুলনায় গ্রামের প্রতিবন্ধী মেয়েরা বেশি সমস্যা-পিড়ীত বলেই মনে হয়।
ঢাকার বাইরে খোঁজ নিতে যেয়ে কক্সবাজারের একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে টেলিফোনে আমার কথা হচ্ছিল।
তিনি পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বলছিলেন ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় তিনি চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
সেই থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন।
বছর দশেক আগে বিয়ে হয় তার। দুই পরিবারের সম্মতিতেই তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু তিনি বলছিলেন তার স্বামী তাকে করুণা করেন বলেন তার মনে হয়।
তিনি বলছিলেন "সে আমাকে কোথাও নিয়ে যায় না, মানুষজনের সামনে বের করতে লজ্জা পায়"।
শিক্ষা ও অর্থ উপার্জনে অনেক পিছিয়ে
ছবির উৎস, BBC Bangla
শহিদুল হক যিনি নিজেও শারিরীক প্রতিবন্ধী
পরিবার বা সমাজে অবহেলা বৈষম্যতো রয়েছে এর সাথে যোগ হয় মেয়ে হিসেবে আলাদা কিছু সমস্যার মুখে পড়া।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল অ্যাসিসট্যান্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফর দ্যা ফিজিক্যালি ভালনারেবল এক গবেষণা বলছে ৫০% প্রতিবন্ধি মেয়ে নিরক্ষর।
অর্থাত তারা লেখাপড়া শেখার ন্যুনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছেলেদের হার সেখানে ৪০%।
আর একই ভাবে ৪৯% শতাংশ প্রতিবন্ধী নারী অর্থ উর্পাজনের মত কোন কাজ করেন না। অর্থাত আর্থিক ভাবে তাদের অন্যের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
পুরুষদের হার সেখানে ৩০%। অর্থাত শিক্ষা ও অর্থ উপার্জনের দিক থেকে মেয়ে প্রতিবন্ধীরা ছেলে প্রতিবন্ধিদের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। এর কারণ কি?
সংস্থাটির অফিসে, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছেন শহিদুল হক যিনি নিজেও শারিরীক প্রতিবন্ধী। তিনি বলছিলেন প্রতিবন্ধী একজন নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জীবনের প্রতি পদে পদে নানা মাত্রায় কঠিন সমস্যার মুখে পরেন তারা।
"সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একটি মেয়েকে আমরা সুন্দর,আকর্ষনীয় দেখতে চাই, বাসার ম্যানেজমেন্টে দেখতে চাই কিন্তু সে যদি প্রতিবন্ধী হয় তখন কারো কাছে কাম্য হয় না"।
ছবির উৎস, BBC Bangla
জলি কাওসার। যিনি তার ২৩ বছর বয়সে একটি রোগে হঠাত করে সম্পূর্ন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
যৌন হয়রানির সহজ লক্ষ্য?
জলি কাওসার। যিনি তার ২৩ বছর বয়সে একটি রোগে হঠাত করে সম্পূর্ন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অভিজ্ঞতা জানাতে যেয়ে বলছিলেন -একটা মেয়ে খুব সহজে যৌন হয়রানির শিকার হয়।
"যারা হুইল চেয়ারে চলে তারা খুব সহজে অন্যের দ্বারা অ্যাবিউজ হয়, শরীরে হাত দেয়। আমি যখন বাসে আসি বা রাস্তায় বের হই তখন আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার শরীরে হাত দিয়ে বসে। আমি কিছুই বলতে পারিনা"।
সরকার কী করছে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য?
বাংলাদেশে ঠিক কি সংখ্যাক নারী প্রতিবন্ধী রয়েছে তার কোন সরকারি পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে একটি প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন করা। কিন্তু নারী প্রতিবন্ধীদের এই যে সমস্যা তার সুরাহা করতে সরকার কি করছে?
সরকারের সমাজকল্যান অধিদপ্তরের পরিচালক জুলফিকার হায়দার বলছিলেন "শুধুমাত্র নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য বিস্তর কর্মকাণ্ড নেই সত্য। যা আছে তা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আছে। তবে আটটি বিভাগে শুধু মাত্র মেয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আবাসিক স্কুল তৈরির প্রক্রিয়া চলছে এখন"।
কত মেয়ে প্রতিবন্ধী আছে সেটা কেন সরকারি পরিসংখ্যান নেই?এমন প্রশ্নে তিনি বলেন "সেটার কাজ চলছে, আগামি জুন নাগাদ জানতে পারবেন কত নারী প্রতিবন্ধী আছে"।
তবে শুধু যে মেয়েরাই সমস্যার মুখে পড়ছেন তা নয়। প্রতিবন্ধি মেয়েকে বড় করতে যেয়ে বাবা -মা দের পরতে হয় নানামুখি সমস্যায়। যেটা হয়ত একটা ছেলের ক্ষেত্রে হয় না।
একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের অভিভাবক
প্রতিবন্ধী নারীদের হয়রানির বিষয়ে এখন অনেকেই প্রতিবাদ করছেন
শাহিন সুলতানার একটি মেয়ে সন্তান শারিরীক প্রতিবন্ধী। মেয়েটির বয়স ২৪ বছর।
একজন প্রতিবন্ধী মেয়ের অভিভাবক হিসেবে শাহিন সুলতানা মনে করেন, একটি ছেলের তুলনায় একজন মেয়ে যদি প্রতিবন্ধী হয় তাহলে নানামুখি সমস্যার মুখে পরতে হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের।
"আমার মেয়ে প্রতিবন্ধী, আমি সব সময় তার পাশে থাকি, অনান্য সমসার তো রয়েছে,সেই সাথে মনে হয় আমার মেয়েকে যদি কেও ফিজিক্যালি অ্যাবইউজ করে করে তাহলে সে ঠেকাতে পারবে,কিছু করতে পারবে না। সেটাই বড় টেনশন। আর এই টেনশন আমাকে সারাজীবন করতে হবে"।
মেয়েদের সন্তান ধারণ করার বিষয় থাকে। একটি স্বাভাবিক মেয়ের জন্য এই সময়টি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ , সেখানে একটি প্রতিবন্ধি মেয়ের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জলি কাওসারের একটি ছেলে, কিন্তু এই ছেলেকে মা হিসেবে সে কোন দিন যে দেখতে পারবে না সেই বেদনা-তার দৃষ্টি হারানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট বলে মনে হয়। আর এমন না বলা বহু কষ্টের গল্প প্রতিবন্ধী নারীদের চলার পথের সঙ্গি হয়ে রয়েছে।
প্রধান খবর
চিঠিপত্র ও মতামত
এডিটার'স মেইলবক্স: আল জাজিরা নিয়ে 'একপেশে' আর চীন-ভারত নিয়ে দ্বিচারিতা?
বাংলাদেশে আল জাজিরার প্রতিবেদন নিয়ে আলাপ-আলোচনার মনে হচ্ছে কোন শেষ নাই।