ভারতের ত্রিপুরায় বাঙালি-উপজাতি সম্পর্কে আবারও ফাটল?
- শুভজ্যোতি ঘোষ
- বিবিসি বাংলা, দিল্লি

ছবির উৎস, AFP Contributor
টিপরাল্যান্ড-এর দাবিতে আইপিএফটি সমর্থকদের বিক্ষোভ।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার ভোটে বিজেপি এবারে নির্বাচনী সমঝোতা করেছে উপজাতিদের দল আইপিএফটি-র সঙ্গে, যারা মাত্র কয়েক মাস আগেই আলাদা রাজ্যের দাবিতে ত্রিপুরা অচল করে দিয়েছিল।
বাঙালিরা ত্রিপুরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অন্তত ১৯টি উপজাতির বাস ওই রাজ্যে, এবং সেখানে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘাতের এক রক্তাক্ত ইতিহাসও আছে।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টকে হঠাতে বিজেপি যেভাবে ত্রিপুরার উপজাতীয় দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, তাতে কি সেখানে জাতিগত বিভাজনের পথই প্রশস্ত হবে?
ত্রিপুরার নানা প্রান্তে ঘুরে সরেজমিনে তারই খোঁজখবর নিয়েছিলাম গত কয়েকদিনে।
'টিপরাল্যান্ড' - ছোট্ট ত্রিপুরার ভেতরেই উপজাতিরা এই নামেই আলাদা একটি রাজ্য চাইছেন।
আর নির্বাচনের আগে বিজেপি সেই টিপরাল্যান্ড সমর্থকদের কাছে টানাতে অশনি সংকেত দেখছেন বামপন্থীরা।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বর্ষীয়ান নেতা গৌতম দাসের কথায়, "আমাদের এখানে শান্তি আর সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করতেই কিন্তু আইপিএফটি-র সঙ্গে তাদের হাত মেলানো। তবে এই আলাদা রাজ্যের দাবিও হুট করে হয়েছে তা নয়।"

ছবির উৎস, ARINDAM DEY
ত্রিপুরার রাঙামাটিতে নির্বাচনী ভাষণ দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী।
আরও দেখুন:
"আপনারা জানেন ৮০র দশকে টিএনভি-র নামে তাদের নেতা বিজয় রাংখল স্বাধীন ত্রিপুরার স্লোগান দিয়েছিলেন। বিদেশি খেদাও-য়ের ডাকও উঠেছিল। কিন্তু উপজাতি-অনুপজাতিরা একজোট হয়ে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর ধরে আবার তারা এই স্লোগান তুলেছে - এবং সেই টিএনভি থেকেই কিন্তু এই আইপিএফটি সংগঠনের জন্ম", বলছিলেন গৌতম দাস।
ত্রিপুরাতে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজীব ভট্টাচার্য আবার পাল্টা যুক্তি দেন, সিপিএমের কাছে এ রাজ্যের ত্রিপুরী-জামাতিয়া-চাকমা-রিয়াংদের মতো জনগোষ্ঠীগুলো প্রতারিত হয়েছে বলেই তারা আলাদা রাজ্যের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন।
মি. ভট্টাচার্যর কথায়, "জনজাতিদের মধ্যে একটাই বার্তা গেছে, যাদের আমরা বিশ্বাস করে শাসনক্ষমতায় বসিয়েছিলাম তারা আমাদের সঙ্গে এত বড় ধোঁকা দিল! বাম শাসনে তাদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি বলেই জনজাতিদের মধ্যে একটা আকুতি এসেছিল যে না, আমাদের একটা নিজস্ব পৃথক রাজ্য দরকার।"
ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান ড: গৌতম চাকমা অবশ্য বলছিলেন, আলাদা রাজ্যের দাবি পূরণ হয়তো এখন সম্ভব নয়, তবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি অন্য কোনও বিকল্প দিলেও দিতেও পারে।

অধ্যাপক গৌতম চাকমা
প্রফেসর গৌতমের কথায়, "রাজ্য না-হোক, টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল একটা হতেই পারে। আসলে আশির দশকের ভয়াবহ দাঙ্গার পর থেকেই এ রাজ্যে একটা এথনোসেন্ট্রিজম (অর্থাৎ শুধু নিজের সংস্কৃতির আলোয় অন্যদের দেখার চেষ্টা) তৈরি হয়েছে এবং এখনও সেটা বাড়ছে।"
"আসলে ত্রিপুরা এমনিতেই অভিবাসীদের রাজ্য। বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা বহুদিন ধরে এখানে এসে বসবাস করছে এবং প্রতিনিয়ত এটা চলছেই। এর ফলে ট্রাইবালদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চারও হয়েছে - এবং তারা এখন নিজেদের সুরক্ষার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা চাইছে। সেটাই মূল কথা। "
কিন্তু ত্রিপুরার সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন এবারের ভোট রাজ্যে 'এথনিক ফল্টলাইন' বা জাতিগত বিভাজনগুলোকে সামনে এনে দেবে?
রাজভবনের সামনে কথা হল উপজাতি সমাজের আধুনিকা তরুণী শর্মিলি চিসিমের সঙ্গে।
শর্মিলি বলছিলেন, "এমনিতে আমাদের এখানে এথনিক রিলেশনশিপ ভালই ছিল - তবে রাজনীতির কারণে তাতে নানা ইস্যু এখন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তা ছাড়া বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে আমাদের কখনও কিন্তু কোনও এথনিক ইস্যু সামলাতে হয়নি।"
"বাঙালিদের মধ্যে আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব, এমন কী আত্মীয় স্বজনও আছে। ফলে আমি বলব যা হচ্ছে সবটাই রাজনীতির কারণে। "
শর্মিলি অবশ্য সেই সঙ্গেই বলেন, আলাদা রাজ্যের দাবি কেন উঠছে সেটাও মানুষকে বুঝতে হবে - এবং এই দাবির পেছনে কিছু যথার্থ কারণও আছে।

রাজীব ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, ত্রিপুরা বিজেপি।
তবে বিজেপি-আইপিএফটির সমঝোতা রাজ্যে শান্তির জন্য তত ভাল নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা অভিজিৎ বর্মনের, যাকে ঠিকাদারির কাজে গোটা ত্রিপুরা চষে বেড়াতে হয়।
তার কথায়, "বর্তমানে যে সিপিএম সরকার আছে তারাই ক্ষমতায় থেকে গেলে কোনও সমস্যা নেই, বাঙালি-ট্রাইবাল মিলেমিশেই থাকতে পারব। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদল হলে অসুবিধা হতে পারে, এমন একটা ডর-ভয় কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।"
অভিজিৎ আরও বলছিলেন, "এখন ধরুন যে কোনও কাজে রাজ্যের যেখানে সেখানে, বহু ভেতরেও অনায়াসে চলে যেতে পারি। কিন্তু আইপিএফটি যেভাবে কিছুদিন আগেও দিনের পর দিন রাস্তা আটকে রেখেছিল, অনেকের ওপর হামলা পর্যন্ত করেছিল - তাতে কি তারা ক্ষমতায় এলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব?"
আর গত বছরের সেই অবরোধ আন্দোলন হয়েছিল সরাসরি কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের মদতেই, অভিযোগ সিপিএমের।
গৌতম দাস বিবিসিকে বলছিলেন, "গত মে মাসে টিপরাল্যান্ডের দাবি নিয়ে আইপিএফটি-র নেতারা তিন তিনবার বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে দেখা করলেন। জিতেন্দ্র সিং না কি তাদের বলেছিলেন, ডেপুটেশন দিয়ে আলাদা রাজ্য হয় না - আপনারা আন্দোলন না-করলে আমরা কী করতে পারি?"

অধ্যাপক পরমা চাকমা
"তারপরই আমরা দেখলাম জুলাই মাসে ত্রিপুরাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল। রেলপথ, হাইওয়ে আটকে রাখা হল দশদিন ধরে। আর তারা লিফলেট বিলি করল, বিজেপির মন্ত্রীরাই তাদের এই আন্দোলন করতে বলেছেন।"
ত্রিপুরার বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করছে, রাজ্য ভাগের দাবিকে কখনওই তারা প্রশ্রয় দেয়নি, দেবেও না। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারেও নেই টিপরাল্যান্ডের উল্লেখ।
বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা রাজীব ভট্টাচার্যের কথায়, "আমাদের সঙ্গে যখন তাদের নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে আমরা কিন্তু কখনওই জনজাতিদের আলাদা রাজ্যের দাবিকে মেনে নিইনি।"
"আমার তো মনে হয় তারাও এখন সেই দাবি থেকে অনেকটা সরে এসেছেন। জনজাতিদের এখন একটাই দাবি, তাদের প্রকৃত উন্নয়ন করতে হবে। পৃথক রাজ্য বিজেপির মানার প্রশ্নই নেই, কারণ আমরা পৃথক রাজ্যে বিশ্বাসই করি না", বলছিলেন তিনি।
টিপরাল্যান্ডের গান অবশ্য এখনও রাজ্যের নানা প্রান্তেই বাজছে, এবং ঘটনা হল - বাঙালি ও উপজাতীয়রা ভোটের পর মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে পারবেন কি না সে প্রশ্নটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আগরতলায় সমাজতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক পরমা চাকমা অবশ্য বিশ্বাস করেন, আশির দশকের হিংসার দিনগুলো অন্তত আর ফিরবে না।
মিস চাকমা বলছিলেন, "হ্যাঁ ঠিকই - সংঘাত ও প্রতিবাদ এখন গোটা ত্রিপুরা জুড়েই হচ্ছে। তবু আমি বলব আশির দশকের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি বোধহয় দেখতে হবে না - কারণ সে দিনগুলো কত ভয়ঙ্কর ছিল সেই অভিজ্ঞতা ত্রিপুরার হয়েছে।"
"আর তা ছাড়া উপজাতিদের তরুণ সমাজও এখন অনেক বেশি শিক্ষিত ও আলোকিত। হ্যাঁ, তাদের একটা ক্রিটিক্যাল ভিউ থাকতে পারে - তবে এখন দরকার একটা সিভিল সোসাইটি যা সেই ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারে। আসলে বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে আরও বেশি আদানপ্রদান হলেই সমস্যা মিটবে।"
তবু ত্রিপুরাতে আগামী দিনে জাতি সংঘাত আবার মাথা চাড়া দেয় কি না সেই আশঙ্কার চোরা স্রোত নিয়েই রাজ্যের মানুষ রবিবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। বাঙালিরা যেমন, তেমনি উপজাতিরাও।
বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন: