যখন রাস্তাঘাটে পুরুষরা যৌন উৎপীড়নের শিকার হয়

ছবির উৎস, Science Photo Library
ভারতে যত কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, প্রায় সমসংখ্যক পুত্রশিশুও একই হয়রানির শিকার হয়
"আমি কলেজে ভর্তির ফর্ম জমা দিতে গিয়েছিলাম। লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎই পেছন দিক থেকে কেউ আমার গোপনাঙ্গ যেন ছুঁয়ে দিল।"
বিক্রম শুধু এইটুকু বলেছে, আর সেটা শুনেই ওর পাশে বসা তিন বন্ধু হো হো করে হাসতে শুরু করল। তারপরে তারা বিক্রমকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা তারপরে কী হল!
একটু দম নিয়ে বিক্রম বলতে শুরু করেছিল, "যতক্ষণ ওই ফর্ম জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম বারে বারে ওই ভদ্রলোক একই জিনিষ করছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর বয়স ৫০ এর বেশীই হবে।
আর আমি তখন সবে কলেজে ভর্তি হচ্ছি। আমি ওঁকে যখন বললাম, যে আঙ্কল, ঠিক করে দাঁড়ান, তিনি অল্প হেসে বলেছিলেন, 'কী এমন হল তোমার'!
দিল্লিতে চাকরিরত বিক্রমের সঙ্গে এই ঘটনা প্রায় আট বছর আগেকার। কিন্তু এখনও ঘটনাটা সম্পূর্ণ মনে আছে ওর।
ছবির উৎস, FACEBOOK/BIKRAM SINGH
নিপীড়নের শিকার হবার আট বছর পর প্রথম কারো কাছে তা প্রকাশ করেন বিক্রম
"ভদ্রলোকের বয়স বিবেচনা করে অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছিলাম। কিন্তু শেষে রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা বলেছিলাম," জানাচ্ছিলেন বিক্রম।
আরো পড়তে পারেন:
বিবিসিকে বিক্রম বলছিলেন যে এতগুলো বছরে তিনি ওই ঘটনার কথা প্রথমবার খোলাখুলি কাউকে বলছেন যে সংবেদনশীল হয়ে গোটা বিষয়টা শুনবে।
বিক্রম যখন সংবেদনশীলতার কথা বলছিলেন, তখন তার পাশে বসা তিন বন্ধু কোনও মতে হাসি চাপছিল।
উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা কপিল শর্মা এখন দিল্লিতে চাকরী করেন।
তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তাঁর বয়স যখন আরও কিছুটা কম ছিল, সেই সময়ে বাসে বসার জায়গা দেওয়ার নাম করে এক ব্যক্তি বারে বারে তাঁর গোপণাঙ্গতে হাত দিচ্ছিল।
এই দুটি ঘটনাই বলে দিচ্ছে যে শুধু নারী বা কন্যাশিশুরা নয়, পুরুষরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ছবির উৎস, KAPIL SHARMA
বিবিসিকে কপিল শর্মা বলেছেন হেনস্থার শিকার হবার গল্প
পুত্রশিশুদের ওপরে যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ প্রায় দায়ের হয় না বললেই চলে, তাই এর কোনও আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায় না।
তবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, যত সংখ্যক কন্যাশিশুর ওপরে ভারতে নির্যাতন হয়, প্রায় সমসংখ্যক পুত্রশিশুও যৌন হয়রানির শিকার হয়।
সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে পুরুষদের দ্বারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের যৌন হয়রানির ঘটনারও কোনও আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী প্রকাশ্যে গোপনাঙ্গে হাত দেওয়ার মতো হয়রানি সবথেকে বেশী হয় দিল্লি, মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ভোপাল, মহারাষ্ট্রের নাগপুর এবং ছত্তিশগড়ের শিল্পশহর দুর্গ-ভিলাইনগরে ঘটে।
ছবির উৎস, PA
লজ্জা ও সংকোচে এ নিয়ে মুখ খোলেন না পুরুষরা
কিন্তু এই পরিসংখ্যানে কেবল পুরুষদের দ্বারা নারীদের গোপণাঙ্গে হাত দেওয়ার ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যের অসম্মতিতে গোপণাঙ্গে হাত দেওয়া একটি মানসিক বিকৃতি, যাকে ফ্রোটেরিজম বলা হয় মনোবিজ্ঞানে। সেই কাজটি কেন করে একজন পুরুষ?
দিল্লির মনোবিজ্ঞানী প্রবীণ ত্রিপাঠি বলছেন, "এই মানসিক রোগের শিকার ব্যক্তিরা অন্যের সম্মতি না নিয়ে তার গোপণাঙ্গ ছুঁয়ে যৌন তৃপ্তি লাভ করেন।
যৌন নিপীড়নের বেশীরভাগ ঘটনাই নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য করা হয়। আর যেখানে কোনও পুরুষ অন্য পুরুষের ওপরে এই নিপীড়ন চালাচ্ছে, সেখানে নিজের শক্তি আরও বেশী করে প্রদর্শন করার একটা বিকৃত আনন্দ তো আছেই।"
ছবির উৎস, Getty Images
পুরুষদের দ্বারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের যৌন হয়রানির ঘটনার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না
হয়রানির শিকার হওয়া যে দুজনের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে, তারা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো বলছে পুত্রশিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ওপরে যে যৌন নির্যাতন হতে পারে, সেটা তাদের আত্মীয় বন্ধুরা বিশ্বাসই করবেন না।
হেসে উড়িয়ে দেবেন, এই আশঙ্কায় পুরুষেরা কাউকে জানায়ই না ঘটনাগুলো।
আর পুরুষদের যেহেতু স্বাভাবিকভাবে শক্তিমান বলে মনে করা হয়, তাই তাদের ওপরে কেউ প্রকাশ্যে যৌন হেনস্থা করবে, এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। উল্টে হয়রানির শিকার হওয়া পুরুষদেরই কমজোরি মনে করবে।
বিক্রম সিং এবং কপিল শর্মাও ঠিক এই কথাই জানিয়েছেন বিবিসিকে।
ভারতে পুরুষদের ওপরে যৌন নির্যাতনের বিচার করার জন্য আলাদা কোনও আইন নেই।
অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা আর পুত্রশিশুদের ওপরে নির্যাতন অবশ্য 'পকসো আইনে' বিচার হয়।
আইনজীবীদের একাংশ মনে করেন যে ভারতীয় দণ্ডবিধির যে সব ধারায় যৌন হয়রানির বিচার হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে নারীদের ওপরে নির্যাতনের কথা রয়েছে। পুরুষরা যৌন হয়রানির শিকার হলে সেই ধারায় বিচার পেতে পারেন না।
কিন্তু আইনজীবীদেরই আরেকটি অংশ মনে করে ওই একই ধারায় পুরুষরাও যৌন হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ জানাতে পারেন। তদন্তও একই আইনেই সম্ভব।
(মূল প্রতিবেদ: নাভীন নেগি, বিবিসি হিন্দি। বাড়তি রিপোর্টিং: অমিতাভ ভট্টশালী)