‘আমি ওভারব্রিজে দাঁড়িয়েছিলাম ঝাঁপ দেবো বলে’

  • শাহনাজ পারভীন
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
আতিকা রোমা।
ছবির ক্যাপশান,

আতিকা রোমা কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঢাকার বনশ্রী এলাকায় বাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখছিলেন আতিকা রোমা।

তার সাথে দেখা হতেই হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন।

নিজেকে গুছিয়ে বসার পর তার জীবনের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের গল্প শোনালেন।

বলছিলেন গত কয়েক বছর কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি।

"যখনই মানসিকভাবে প্রচণ্ড আহত হতাম, তখনই মনে হতো যে একটাই সহজ উপায় এর থেকে বের হওয়ার। সেটা হল সুইসাইড করা"

"আমি একবার শ্যামলী ওভারব্রিজের ওপরে অনেক রাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঝাপ দেবো বলে। কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থেকেছি ট্রেনের অপেক্ষায়। একবার অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলাম"।

প্রথমবার তার প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো বয়স্ক এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত রাতে এখানে কী করছেন।

ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিজের প্রাণনাশ করার চেষ্টা ছিল সবচাইতে গুরুতর।

কিন্তু সেবার বন্ধু ও পরিবারের জন্য বেঁচে গেছেন।

হাসিমুখেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। তাঁর সমস্যার শুরু কীভাবে, নিজেই তার নানারকম ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন।

পরিবারের সাথে দূরত্ব, মানসিক চাপ, কাজের জায়গায় বাজে অভিজ্ঞতা, মাদকাসক্তি -এমন নানা অভিজ্ঞতার পর মানসিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে হতাশ হয়েছেন আতিকা রোমা।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগা ব্যক্তিদের সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব নেতিবাচক।

তিনি বলছেন, "খুব বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছি। যাওয়ার পর তাদের চিকিৎসা দান পদ্ধতি আমার পছন্দ হয়নি। আমি আমার জায়গা থেকে খুব কষ্টের কিছু কথা বলছি।

আমি চাই সেই কথা যখন শুনবেন, একটা অনুভূতি নিয়ে শুনবেন। কিন্তু ঐ চেয়ারে যিনি বসে আছেন তিনি শোনেন খুবই প্রফেশনাল ওয়েতে। হ্যাঁ বলেন এরপরে কি হয়েছে? আচ্ছা ঠিক আছে শুনলাম। একজন কাউন্সিলরকে আমি বলেছিলাম সব রোগেতো প্যারাসিটামল দিলে হবে না"।

মানসিক রোগীর জন্য চিকিৎসকদের চেম্বারের পরিবেশ থেকে শুরু করে তাদের প্রতি আচরণ, চিকিৎসকদের সংখ্যা সব দিক থেকেই বাংলাদেশে এর চিকিৎসা ব্যবস্থায় মারাত্মক ঘাটতি দেখেছেন তিনি।

সেই ঘাটতি অবশ্য বিভিন্ন জরিপের উপাত্তে একেবারেই স্পষ্ট।

আত্মহত্যার মূল চালিকাশক্তি হল মানসিক রোগ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দেয়া তথ্য মতে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ বা প্রায় ৫ কোটি মানুষ কোন না কোন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এই তথ্য ২০১৬ সালের।

কিন্তু বাংলাদেশে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছে আড়াইশোর একটু বেশি।

আর মানসিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল মাত্র দুটি।

বড় সরকারি হাসপাতালের কয়েকটিতে অল্পকিছু ব্যবস্থা রয়েছে।

কিছু বেসরকারি কেন্দ্র রয়েছে যা মাদকাসক্তির ও মনোরোগের চিকিৎসা একসাথে করে।

আরো পড়ুন:

ভিডিওর ক্যাপশান,

কী কারণে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন রোমা?

ছবির উৎস, বিবিসি বাংলা

ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশে আত্মহত্যা প্রবণতায় ভোগা মানুষদের জন্যে সহায়তার ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল।

আলাদা করে থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলর এদেশে নেই বললেই চলে। মনোরোগ চিকিৎসকেরাই ঔষধও দেন আবার কাউন্সেলিং- এর চেষ্টা করেন।

এই অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণ কি? জানতে চেয়েছিলাম জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোবিজ্ঞানী ডাঃ মেখালা সরকারের কাছে।

তিনি বলছেন, "যখন এমবিবিএস পড়ে তখন স্টুডেন্টরা ঠিক করে নেয় কোন সাবজেক্টে যাবে। যে সাবজেক্টের গুরুত্ব বেশি সেটার দিকেই তাদের ঝোঁক বেশি। আমাদের দেশে প্রচুর জনসংখ্যা, আমাদের রিসোর্স খুব সীমিত। সেই প্রভাবতো সব সেক্টরেই পড়বে। বিশেষায়িত ডাক্তারতো এমনিতে সবক্ষেত্রেই কম"।

তিনি বলছেন, মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ চিকিৎসক হতে গেলে বাংলাদেশে পড়াশুনা করার জায়গাও খুব সীমিত।

কিন্তু সেই তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।

সেই ধারণা পেতে বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা জানতে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হলো।

কারণ এর হিসেব রাখা হয় এ বিষয়ক মামলার সংখ্যা দিয়ে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে আত্মহত্যার মামলা হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজারের মতো।

২০১৬ সালে তা ছিল তিন হাজার বেশি। কত লোক তার চেষ্টা করেছেন সেই বিষয়ক তথ্য পাওয়া যায়নি।

দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা সড়ক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি।

ছবির উৎস, বিবিসি

ছবির ক্যাপশান,

আত্মহত্যার প্রবণতায় ভোগা মানুষদের জন্য কোন হেল্পলাইন নেই।

প্রচুর মনোযোগ ও সরকারি তহবিল পায় এমন রোগে মৃত্যুর চেয়েও আত্মহত্যায় মৃত্যু বহুগুন।

কিন্তু সেই তুলনায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহায়তা এদেশে কেন গড়ে উঠছে না?

জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের কাছে।

তিনি বলছেন, "সাধারণত বাংলাদেশের মতো দেশে সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বেশি থাকে। আমরা সংক্রমণ রোগ নিরসনের জন্য হাসপাতালভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব বেশি দিয়েছি। আমরা মানসিক রোগকে আগে এতটা গুরুত্ব দেইনি।"

কিন্তু সেটি পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানালেন, "আমরা এখন যেটা করছি, সারা দেশে যত চিকিৎসক আছেন, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাদেরকে আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যারা কাউন্সেলিং দেয়া, বিশেষ করে সনাক্ত করা ও রেফার করার কাজটি করতে পারবেন।"

একটি জরুরী হেল্প লাইনেরও চিন্তা চলছে বলে জানালেন তিনি। বাংলাদেশেই ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্যসেবায় ১৬২৬৩ হেল্প-লাইন রয়েছে সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা বাটন সংযুক্ত করা যায় কিনা সেটির চিন্তা চলছে বলে জানিয়েছেন ডাঃ আজাদ।

বিশ্বের অনেক দেশে সরকারিভাবে আত্মহত্যা প্রবণতায় ভোগা মানুষদের জন্য রয়েছে জরুরী হেল্পলাইনসহ নানা ধরনের সেবা।

ছবির উৎস, Majority World

ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশে মানসিক রোগীকে প্রায়শই চেইন দিয়ে বেধে রাখা হয়।

ডাঃ মেখালা সরকার বলছেন, "একটা হেল্প লাইন খুবই জরুরী। কারণ যখনই আত্মহত্যার মতো একটা চিন্তা মাথায় আসে। সেক্ষেত্রে কিন্তু অনেকে একটা শেষ উপায় খোঁজে। সেই সাহায্যের শেষ জায়গাগুলো খোঁজে। কোথাও ফোন করলে সেখানে কথা বলতে পারলে তা সুইসাইড প্রিভেনশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে"

বাংলাদেশে এমন কিছু নেই। খুব সীমিত আকারে 'কান পেতে রই' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি মানসিক সহায়তার হেল্পলাইন তৈরি করেছে।

নিজের পরিবারে এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের উদ্যোগেও কিছু ব্যবস্থা গড়ে উঠছে।

কিছু ফেসবুক গ্রুপও রয়েছে। কিন্তু এই সব উদ্যোগ সমস্যার তুলনায় খুবই সীমিত।

বাংলাদেশে আত্মহত্যা ও মানসিক রোগীদের সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও খুব নেতিবাচক।

এমন পরিস্থিতিতে আতিকা রোমার মতো মানুষজন নিজেকে সামলানোর নানা কায়দা নিজেই তৈরি করে নিচ্ছেন।

কিন্তু যারা তা পারছেন না তারা কোন না সময় নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। হাজার হাজার লোক তাতে সফলও হচ্ছেন।

আতিকা রোমা বলছেন, "বাংলাদেশের যারা আপামর জনসাধারণ, যারা মানসিক রোগে ভোগেন, তাদের মধ্যে যদি আরো এক্সট্রিম অবস্থা থাকে, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি থাকে এবং তাদের যদি কোনই সাপোর্ট না থাকে, তাহলে তাদের মতো অভাগা বাংলাদেশে আর কেউই নেই"।

বিবিসি বাংলার আরো খবর: