ভারতে বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে পুলিশী হানা, প্রমাণ কই?

  • শুভজ্যোতি ঘোষ
  • বিবিসি বাংলা, দিল্লি
ভারত

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কবি ভারভারা রাওকে হায়দ্রাবাদ থেকে আটক করা হয়

ভারতের নানা শহর জুড়ে গত সপ্তাহে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও অধিকারকর্মীদের বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করলেও তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।

আদালতের আদেশে গৃহবন্দী ওই অ্যাক্টিভিস্টদের আইনজীবীরা বলছেন, তাদের মক্কেলরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন অভিযোগ একেবারেই হাস্যকর।

মহারাষ্ট্র পুলিশ যদিও সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রমাণ মেলার দাবি করেছে - কেন সেগুলো আদালতে পেশ করা হয়নি এই প্রশ্নও তুলছেন অনেকেই।

তাহলে কি কোনও প্রমাণ ছাড়াই ভারত সরকার এই বুদ্ধিজীবীদের আটকে রেখেছে?

গত ২৯ আগস্ট ভারতের ন'টি শহর জুড়ে বামপন্থী লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টদের বাড়িতে একযোগে যে পুলিশি অভিযান চালানো হয়, তারপর তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন এখনও গৃহবন্দী।

এই অভিযানের কারণ হিসেবে মহারাষ্ট্র পুলিশ একটি গোপন চিঠি পাওয়ার কথা বলেছিল, যাতে রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ডের ধাঁচে মিশন চালানোর উল্লেখ ছিল। কিন্তু সেই চিঠিটির উৎস কী, বা সেটি জাল কি না - তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

ইতিমধ্যে অভিযুক্ত বুদ্ধিজীবীদের একজন, দিল্লির গৌতম নওলাখার আইনজীবী নিত্যা রামাকৃষ্ণন বলছেন, "গৌতমের ক্ষেত্রে আমি যেমন বলতে পারি মারাঠিতে লেখা একতাড়া কাগজ নিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসে। ওই কাগজগুলো ছিল গত ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে করা এফআইআরের প্রতিলিপি, যে অনুষ্ঠানের পর পুনেতে দাঙ্গা হয়েছিল।"

"দাঙ্গার সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানের কোনও সম্পর্ক ছিল কি না সেটাও একটা প্রশ্ন, আর এদিকে আপনি মারাঠিতে লেখা একটা এফআইআর নিয়ে দিল্লিতে একজনকে আটক করতে চলে এলেন, যার সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানের কোনও সম্পর্কই নেই!"

গৃহবন্দী ওই অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে এরপর ইউএপিএ আইনে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগও আনা হয়েছে।

আর মহারাষ্ট্র পুলিশ শনিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে অকাট্য সব সাক্ষ্যপ্রমাণও পাওয়া গেছে।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখাকে দিল্লি থেকে গ্রেফতার করা হয়

রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পরমবীর সিং সেখানে বলেন, "অভিযুক্তদের সবাই যে মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন সেটার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।"

"তারা কে কোন দায়িত্ব কীভাবে পালন করতেন, মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ রাখতেন সে সব প্রমাণ আমরা তাদের বাড়ি থেকে পাওয়া নথিপত্র কিংবা ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করেছি।"

ওই অ্যাক্টিভিস্টদের লেখা চিঠি বলে দাবি করে তা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও বর্ণনা দেন, কীভাবে কমরেড প্রকাশ নামে জনৈক মাওবাদী নেতার মাধ্যমে তারা মাওবাদীদের জন্য গ্রেনেড লঞ্চার ও অন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ, হামলা চালানো বা টাকাপয়সা জোগাড় নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন।

কিন্তু সরকারকে উৎখাত করা বা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা প্রচেষ্টার দাবি করা হলেও পুলিশ কেন সে কথা আদালতে বলেনি, প্রশ্ন তুলছেন ভারতে সিপিআই (এম এল) দলের শীর্ষ নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, "প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টাই যদি হত তাহলে তো এই কেস ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির হাতে তুলে দেওয়ার কথা। তা না-করে এটা পুনের একটা থানার হাতে ছেড়ে রাখা হয়েছে, আর তার মারাঠিতে লেখা একটা এফআইআর নিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে - এটা কেমন কথা হল?"

"আসলে আমার ধারণা এখানেও পুরনো সেই গুজরাট প্যাটার্ন ফলো করা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার চেষ্টা হচ্ছিল, এই জিনিস এই নিয়ে আমরা বোধহয় আটবার শুনলাম। চার্জ যতি এতই সিরিয়াস, তাহলে গত তিন মাসে কেন তদন্ত শেষ করা হয়নি - আরও কেন বাড়তি সময় লাগছে? আসলে পুরো ব্যাপারটায় সন্দেহ আরও বাড়ছে, প্লট ইস থিকেনিং", বলছিলেন তিনি।

দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনীষা শেঠিও মনে করেন, "আদালতে প্রমাণ পেশ না-করে সাংবাদিক বৈঠকে জাল চিঠিপত্র হাজির করে মানুষের আদালতে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা, এটা ভারতীয় পুলিশের পুরনো একটা কায়দা।"

"এতে কোর্টরুমের বাইরে অভিযুক্তদের দেশবিরোধী বা সন্ত্রাসবাদী বলে তুলে ধরতে হয়তো সাহায্য হয় - কিন্তু আদালতে গ্রাহ্য হওয়ার মতো কোনও প্রমাণ যে তাদের কাছে নেই তা তো দেখাই যাচ্ছে।"

এই একই মামলায় গত জুন মাসেই মহারাষ্ট্রে পাঁচজন লেখক-বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ, এখন চার্জশিট দাখিলের জন্য তারা আরও তিন মাস বাড়তি সময় পেয়েছে।

অধ্যাপক মনীষা শেঠির মতো ভারতে অনেকেরই আশঙ্কা, এই নব্বই দিনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরও জাল তথ্যপ্রমাণ জড়ো করার চেষ্টা হতে পারে।

বিবিসি বাংলার আরো খবর: