লটারিতে পাওয়া ৪০ লাখ পাউন্ড যেভাবে বদলে দিল মেলিসার জীবন

মেলিসা তার প্রেয়সী র‍্যাচেলের সাথে নাচছেন।
ছবির ক্যাপশান,

মেলিসা তার প্রেয়সী র‍্যাচেলের সাথে নাচছেন।

হঠাৎ করে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যদি ৪০ লাখ পাউন্ড চলে আসে কী করবেন আপনি? এই অর্থ কিভাবে বদলে দেবে আপনার জীবন?

এরকমই একজন মেলিসা ইড। ব্রিটিশ নাগরিক। থাকেন হাল শহরে। রাতারাতি হয়ে উঠেছেন একজন সেলেব্রিটি।

শহরের রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময় লোকজন তার দিকে ঘুরে তাকান। কথা বলতে এগিয়ে আসেন কেউ কেউ। তাকে নিয়ে অনেক কৌতুহল তাদের।

সাতান্ন বছর বয়সী মেলিসা থাকতেন পুরনো ও ভগ্নপ্রায় একটি বাড়িতে। চালাতেন পুরনো একটি ফোর্ড গাড়ি।

কিন্তু তার সবকিছুই বদলে গেল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে।

গত ক্রিসমাসে সময় গাড়িতে তেল নেওয়ার জন্যে হালের একটি পেট্রোল স্টেশনে গেলে সেখান থেকে ন্যাশনাল লটারির একটি স্ক্র্যাচ কার্ড কিনেছিলেন তিনি।

সামান্য এই কার্ডটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে দামী ক্রিসমাস উপহার।

ছবির ক্যাপশান,

নতুন কেনা গাড়িতা মেলিসা।

আরো পড়তে পারেন:

"আমি যখন নখ দিয়ে কার্ডের উপর স্ক্র্যাচ করলাম, তখন যা দেখলাম সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাকে সেটা তখন বারবার পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছিল," বলেন তিনি।

"মাত্র তিন দিনের মধ্যে আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বদলে গেল। এক পাউন্ড থেকে হয়ে গেল ৪০ লাখ পাউন্ড।"

এখন তিনি নিজের আলাদা একটি বাড়িতে থাকেন। পাঁচ বেডরুমের বাড়ি। সেখানে আরো আছে বিশাল একটি বাগান।

লটারি জেতার আগে তিনি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতেন ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে। মূলত রাতেই কাজ করতেন তিনি।

মেলিসা জানান, তার আয় রোজগার এতোটাই কম ছিল যে তিনি ঠিক মতো বাড়িভাড়া দিতে পারতেন না। এমনকি দিনের জন্যে একবেলার খাবার জোগাড় করতেও তার কষ্ট হতো।

তিনি বলেন, ক্ষুধার্ত থাকার চেয়েও ভয়াবহ ছিল রাতের বেলায় যাত্রীদের সহিংস আচরণ।

মেলিসা ইড বলেছেন, মোটামুটি সব ট্যাক্সি ড্রাইভারকেই এধরনের যাত্রীর পাল্লায় পড়তে হয়। কিন্তু তার বেলায় পরিস্থিতি ছিল আরো খারাপ।

কারণ তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার।

ছবির ক্যাপশান,

মেলিসা যখন ছেলে ছিল।

"আমার গলা টিপে ধরা হয়েছিল, আমার মুখে ঘুষি মারা হয়েছে। গালাগালি করা হয়েছে। একদিন এমনও হয়েছে যে আমি একজন যাত্রীকে তুলেছি। তারপর সে গাড়ির পেছনের সিটে বসেই পেছন থেকে আমার উপর হামলা চালাতে শুরু করলো। হঠাৎ করেই সে আমার দিকে ঝুঁকে এল। তারপর আমার গলা টিপে ধরলো," বলেন মেলিসা।

"আমি খুব ভাগ্যবান কারণ আমি পুলিশ স্টেশনের খুব কাছেই ছিলাম। তখন আমি গাড়িটি ডান দিকে থামাই। পুলিশ যখন দরজা খুললো তখনও যাত্রী তার দুই হাতে আমার গলা টিপে ধরে রেখেছে।"

কিন্তু লটারি জেতার পর তিনি তার সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

মেলিসা ইডের আগে অন্য একটা নাম ছিল। লেস। তখন তিনি ছিলেন বিবাহিতএকজন পুরুষ। কখনও কখনও তার গোঁফও ছিল।

কিন্তু তিনি জানান যে তার নিজেকে কখনও পুরুষ বলে মনে হতো না। এমনকি শৈশবেও তিনি ছেলেদের খেলনা দিয়ে খেলতে আগ্রহী ছিলেন না। তার চুল কেটে ছোট করে ফেলাও তার ভাল লাগতো না।

"আমি আমার বাবা মাকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে আমি ছেলে নই। কিন্তু তারা আমার কথা শুনতো না।"

তিনি জানান, এসব কথা শুনে তারা হাসতেন। আবার অনেকেই ভাবতেন যে তিনি হয়তো একজন সমকামী পুরুষ।

এজন্যে স্কুলে তাকে অনেক কটু কথা শুনতে হতো।

তারপর তার বিয়ে হলো। চার সন্তানের পিতাও হলেন তিনি। কিন্তু সেই বিবাহিত জীবন স্থায়ী হলো না।

"ওটা আসলে কোন জীবন ছিল না," তার পুরুষ জীবন সম্পর্কে এভাবেই বলেন মেলিসা।

ছবির ক্যাপশান,

নারীতে রুপান্তরিত হওয়ার আগে মেলিসা।

ওই সময়টা ছিল মেলিসার জন্যে খুব কঠিন সময় কারণ তিনি নিজে যা নন সেরকম একটা কিছুর অভিনয় করতে হচ্ছিল তাকে। "পুরো জীবনটাই ছিল একটা মিথ্যা। একটা বড় অভিনয়।"

এরকম চলতে থাকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যখন লেস হয়ে যান মেলিসা।

তার এই পরিবর্তন অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। ফলে তাকে অনেক বন্ধু হারাতে হয়েছে।

তার পিতামাতার সাথে সম্পর্কও তখন শেষ হয়ে আসতে থাকে। এসময় তারা মারা যান।

"তারা আমাকে বলেছিলেন নারীর পোশাক পরে আমি যেন তাদের ধারে কাছেও না যাই। তারা চাইতো না আমি তাদের বাড়িতে যাই। তখন থেকেই তাদের সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেল। আমি হয়তো ছেলেদের পোশাক পরে পুরুষের বেশ ধরে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার মন চাইছিল না," বলেন মেলিসা।

ছবির ক্যাপশান,

এখন মেলিসা, তার বাড়ির বাগানে।

সন্তানদের সাথেও তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তাদের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

মেলিসা জানান, তার এই পরিবর্তন যে নিজের সন্তানদের মধ্যে একটা সমস্যা তৈরি করবে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন আর সে কথা ভেবে তিনি সন্তানদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

এখন আবার তার সব ছেলেমেয়ের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে তাদের একজন মেলিসার লটারির জেতার পর তার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।

"জীবনে আর কাকে বিশ্বাস করবেন আপনি? প্রশ্ন মেলিসার।

তবে একজনকে তিনি ঠিকই বিশ্বাস করেন। তিনি হচ্ছেন তার প্রেমিক ৩৭ বছর বয়সী র‍্যাচেল নেসন। তার আগের ঘরে আছে পাঁচটি সন্তান এবং মেলিসার চেয়েও ২০ বছরের ছোট তিনি।

মেলিসা জানান, লটারি জেতার কয়েকদিন আগেই তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

আপনারা হয়তো ভাবছেন যে মেলিসা এখন হয়তো প্রচুর অর্থ খরচ করে জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে করবেন। কিন্তু না, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে খুব কাছের অল্প কিছু লোকজনকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে।

আর বিয়ের পোশাক কিনবেন হালেরই একটি চ্যারিটির দোকান থেকে, যেখান থেকে তিনি প্রায়শই পুরনো জিনিস কিনে থাকেন।

ছবির ক্যাপশান,

ক্লাবে নাচছেন মেলিসা।

লটারি জেতা হাজার হাজার নারী পুরুষের উপর যারা গবেষণা চালিয়েছেন, তারা বলছেন, প্রচুর অর্থ পাওয়ার পর প্রথম প্রথম যে ধরনের উত্তেজনা থাকে সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

তারা দেখেছেন, লটারী জয়ী মানুষেরা, লটারি পাওয়ার পাঁচ বছর পরে যে অন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে সুখী জীবন যাপন করছেন তার কোন প্রমাণ তারা গবেষণায় দেখতে পান নি।

কিন্তু মেলিসা বলছেন, "অর্থ জমানোর জন্যে আমাকে এখন আর চিন্তা করতে হয় না। কিছু কিনতে হলে দোকানে চলে যাই এবং যা পছন্দ হয় সেটা কিনে ফেলি," বলেন মেলিসা। আর এটাই তার জন্যে এখন সবচেয়ে আনন্দের। লটারি জেতার পর এটাই মেলিসার নতুন জীবন।