'ইয়াবা যুগে' বাংলাদেশ: ফুলেফেঁপে কতটা বড় হয়েছে মাদকের বাজার?
- আকবর হোসেন
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশে এখন বহুল প্রচলিত মাদক ইয়াবা।
একসময় গাড়ির ব্যবসা করতেন আনোয়ার হোসেন (এটি তাঁর ছদ্মনাম)। আয়-রোজগারও ভালোই ছিল।
মাসে গড়ে এক লক্ষ টাকার মতো আয় করতেন তিনি। কিন্তু এই আয়ের বড় একটি অংশ চলে যেত ইয়াবা সেবনের পেছনে।
"দেখা যেত আমার অ্যাভারেজ (গড়ে) ২০০০ টাকা খরচ হচ্ছে প্রতিদিন। আমার ইনকামের ম্যাক্সিমাম অংশ ড্রাগে ইউজ করে ফেলতাম," বলছিলেন আনোয়ার হোসেন।
এ পর্যায়ে মাসে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা ইয়াবা সেবনের জন্য খরচ হতো তাঁর। সেই চক্করে পড়ে প্রায় সবই হারিয়েছেন তিনি।
কিভাবে ইয়াবার প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছিল, সেই বর্ণনাই আমাকে দিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘসময় চিকিৎসা নেবার পর এখন তিনি নিজেকে মাদক মুক্ত দাবি করছেন।
ইয়াবায় আসক্তির এমন অজস্র কাহিনী এখন পাওয়া যায়।
বিবিসি বাংলায় আরও যেসব খবর:
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন খুব জরুরী বিষয়। ঢাকা শহরে বেসরকারি উদ্যোগে এ ধরণের প্রায় শতাধিক চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
তেমন একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রের নাম ক্রিয়া। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার তরুণ কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, পরিস্থিতির কোন উন্নতি তিনি দেখছেন না।
বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার যে প্রকট আকার ধারণ করেছে, তা নিয়ে কারো মধ্যে কোন বিতর্ক নেই।

ছবির উৎস, Getty Images
মাদক বিরোধী অভিযানে ২০০'র বেশি নিহত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় মাদকের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমদাদুল ইসলাম। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে মাদকের ক্ষেত্রে এখন 'ইয়াবা যুগ' চলছে, কারণ বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী।
মাদকের বাজার
অধ্যাপক ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে একটা সময় মাদক হিসেবে ফেনসিডিল বহুল প্রচলিত থাকলেও ১৯৯৯ সাল থেকে ইয়াবা ধীরে ধীরে ওই জায়গা দখল করে নেয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে যেখানে ১,২৯,০০০ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল, সেখানে ২০১৭ সালে চার কোটি ইয়াবা আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
"সাধারণত ড্রাগস যা ধরা পড়ে, প্রকৃত চালানটা হয়তো তার চেয়ে দশগুণ বেশি। নাইনটি পার্সেন্ট দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪০ কোটি পিস ইয়াবা বাজারে ঢুকছে," বলছিলেন অধ্যাপক ইসলাম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ইয়াবাসেবীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। প্রতিদিন একজন ইয়াবাসেবীর ১০-১২টি ট্যাবলেট প্রয়োজন হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ছবির উৎস, AFP
বাংলাদেশে প্রতিদিনই ইয়াবা আটক করা হচ্ছে।
একটি ইয়াবার দাম ২০০ টাকা হলে এ থেকে মাদকটির বাজার সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই প্রায় সাড়ে চার কোটি ইয়াবা আটক করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ইয়াবা ব্যবহার করছে।
সেই হিসেবে বাংলাদেশে শুধু ইয়াবার বাজার প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ গত চার মাস ধরে চলছে মাদকবিরোধী অভিযান। এখন পর্যন্ত এ অভিযানে মৃতের সংখ্যা দুইশো ছাড়িয়েছে।
অভিযান
মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং বিশ্লেষক খন্দকার ফারজানা রহমান মনে করেন, এ ধরণের অভিযান কতটা কাজে লাগবে তা নিয়ে তাঁর সংশয় আছে।
"আপনি তাদের ধরে শাস্তি দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু নতুন ড্রাগ অ্যাবিউজার তৈরি হবে না সেটাও আপনাকে এনশিওর করতে হবে," বলছিলেন ফারজানা রহমান।
তিনি বলেন বাংলাদেশের সীমান্তে ২৫০টি পয়েন্ট আছে যেগুলোর ভেতর দিয়ে মাদক বাংলাদেশে আসে।
তিনি মনে করেন শুধু 'চুনোপিুটিদের' ধরে সমস্যার কোন সমাধান হবে না।

ছবির উৎস, khandaker farzana rahman
খন্দকার ফারজানা রহমান।
সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের মাদক কারবারির তালিকা হালনাগাদ করেছে।
পেছনে কারা?
ওই তালিকায় কক্সবাজার এলাকায় জনপ্রতিনিধিসহ ৭০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে - অনেকেই নাম এসেছে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বলে পরিচিতি রয়েছে।
খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই যে মাদক কারবারের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকে সেটি এখন আর কারো অজানা নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন বড় হয়েছে তেমনি মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। ফলে মাদক বিক্রির পরিধিও বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্লেষক সায়মা হক বিদিশা বলেছেন, মাদক ব্যবসা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এর কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন তিনি।
প্রথমত; মাদক ব্যবসা অবৈধ হওয়ার কারণে যারা এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করে দিতে চায়।

ছবির উৎস, BBC BANGLA
সায়মা হক বিদিশা
দ্বিতীয়ত; অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন থাকায় এ খাত থেকে অর্জিত অর্থ অন্য জায়গায় বিনিয়োগ হয় না।
তৃতীয়ত; যে ব্যক্তি মাদকের জন্য টাকা ব্যয় করছেন, তিনি যদি মাদকাসক্ত না হতেন তাহলে সে টাকা অর্থনীতির অন্য খাতে ব্যয় হতো।
চতুর্থত; মাদকের বিস্তার লাভ করলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে সেটি ব্যবসা খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে।
এছাড়া মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট নানাবিধ রোগের কারণে স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে।
বিশ্লেষকর বলছেন, মাদকের বিস্তারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, সেই একই অবস্থা মোকাবেলা করছে পৃথিবীর অনেক দেশ।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্লেষক ইমদাদুল ইসলাম বলছেন, দেশের ভেতরে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে ক্ষুদে মাদক কারবারিরা অর্থ উপার্জনের জন্য আর ওই পথে যাবে না।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মাদকের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলমান থাকবে। যেই জড়িত থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না - এমন কথা বলেন কর্মকর্তারা।
একই সাথে যেসব জায়গা দিয়ে দেশের ভেতরে মাদক আসে, সীমান্তের সেসব জায়গায় নজরদারীও বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাই বলুক না কেন, বাস্তবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ না হলে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হবে সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।