অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টকে কি হুমকি দিয়ে রাখলেন বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ?
- শুভজ্যোতি ঘোষ
- বিবিসি বাংলা, দিল্লি

ছবির উৎস, The India Today Group
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ কেরালায় গিয়ে প্রকাশ্যে সুপ্রিম কোর্টের শবরীমালা রায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পর অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে রায়ের আগে তিনি শীর্ষ আদালতকে একটা বার্তা দিতে চাইছেন।
যেখানে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্ন জড়িত - সেখানে যেন সুপ্রিম কোর্ট নাক না-গলায়, অমিত শাহর বক্তব্য থেকে এটাই বেরিয়ে আসছে বলে বিরোধী নেতারা অনেকেই মনে করছেন।
বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি অবশ্য বিবিসিকে বলছে তারা এই 'হুমকি'তে আদৌ বিচলিত নয় - আর আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মি শাহ-র মন্তব্য আদালত অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঠিক এক মাস আগে এক ঐতিহাসিক রায়ে কেরালার শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী বয়সের মহিলাদেরও প্রবেশাধিকার দিয়েছিল - কিন্তু গত সপ্তাহে দিন পাঁচেকের জন্য যখন সেই মন্দির খোলে তখন ভক্তদের তুমুল বাধায় ওই বয়সের কোনও মহিলাই ভেতরে ঢুকতে পারেননি।
ছবির উৎস, AFP
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে যে দিন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২
এরপর কেরালা গিয়ে বিজেপির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ সেই প্রতিবাদকারী ভক্তদের শুধু 'পাথরের মতো শক্ত' সমর্থনই জানাননি, মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের এমন কোনও রায় দেওয়া ঠিক নয় যা প্রয়োগ করা যায় না।
কেরালা সরকার ভক্তদের ধরপাকড় করলে তাদের উৎখাত করারও হুমকি দিয়ে রেখেছেন মি শাহ।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মীরা ভাটিয়া অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু করাটাই আদালত অবমাননা। সুতরাং অমিত শাহ-ও এখানে সেই দোষে দোষী।"
"আর শুধু ধর্মবিশ্বাস কেন, কোনও কিছুর দোহাই দিয়েই আপনি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারেন না - সেই রায় আপনাকে অক্ষরে অক্ষরে মানতেই হবে, রায় ঘোষণার পর দ্বিতীয় কোনও ব্যাখ্যার অবকাশই নেই।"
অমিত শাহ-র বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট স্বত:প্রণোদিত ব্যবস্থা নিক, এদিন সেই দাবি জানিয়েছেন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতীও।
ছবির উৎস, Hindustan Times
বসপা নেত্রী মায়াবতীর দাবি, সুপ্রিম কোর্ট অমিত শাহ্-র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক
সিপিআই(এম এল)-র সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আবার মনে করছেন, পঁচিশ বছর আগে বাবরি মসজিদ ভেঙে যেমন বিজেপি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছিল - এখন রামমন্দির নিয়ে রায়ের আগেও সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে।
তার কথায়, "৯২-তে যখন বাবরি ভাঙা হয়েছিল, সেটা ছিল সুপ্রিম কোর্টকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করা। কিন্তু এখন যেটা করা হচ্ছে সেটা হল সুপ্রিম কোর্টকে পরিষ্কার ডিক্টেট করার চেষ্টা!"
"পার্লামেন্ট থেকে বলা হচ্ছে, রামমিন্দর বানাতে হবে। কেরালা গিয়ে বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট এমন রায় দিক যেটা কার্যকর করা যাবে। কিংবা তারা বুঝুক, দেশের মানুষ কী চায়! তো এটা ডিক্টেট করা ছাড়া আর কী!"
মানুষের আস্থা বা ধর্মবিশ্বাসের যে যুক্তি বিজেপি দিচ্ছে, সেটা আদালতের বিচার্য হতে পারে না বলেও মনে করেন তিনি।
ছবির উৎস, Pacific Press
সিপিআই(এম এল)-র নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
"আসলে আমার মনে হয় কেরালা ও অযোধ্যা এখানে এক সূত্রেই গাঁথা। দেশে তো আর এক রকম আস্থা বা ট্র্যাডিশন নেই, অনেক রকম আছে। নব্বই সালের আগে শবরীমালাতেও তো যুবতী মেয়েরা ঢুকতে পারতেন।"
"কাজেই আস্থা বা ট্র্যাডিশনের কথা নেহাতই অজুহাত - এসব বলে বিজেপি নিজেদের পছন্দ মতো দেশের শাসন ব্যবস্থা সাজিয়ে নিতে চাইছে", বলছিলেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
সুপ্রিম কোর্টে রামমন্দির নিয়ে যে মামলার দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে আছে, তার অন্যতম পক্ষ বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি।
সেই কমিটির সিনিয়র সদস্য জাফরইয়াব জিলানি বিবিসিকে বলছিলেন, অমিত শাহ-র ধমকিতে তারা কিন্তু ভয় পাচ্ছেন না।
ছবির উৎস, The India Today Group
বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির জাফরইয়াব জিলানি
মি জিলানির কথায়, হ্যাঁ, "উনি একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন ঠিকই - তবে তাতে আমরা ডরানোর পাত্র নই। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের হুমকি-ধমকি বা প্রভাব খাটানোর চেষ্টার অনেক ঊর্ধ্বে।"
"১৯৯৪ সালে শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চই স্থির করে দিয়েছে, এই মামলা শ্রীরাম জন্মভূমি ন্যাস ও বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি আমাদের এই দুপক্ষের মধ্যে - এখানে কোনও দলের নেতা কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না।"
"তবে দেশের ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডেন্ট যখন এই ভঙ্গীতে কথা বলেন তখন বোঝাই যায় তিনি আদালতকেও মানেন না।"
নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, বিজেপির ঘোষিত অবস্থান হল রামমন্দির নির্মাণের প্রশ্নে তারা দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই মেনে নেবে।
কিন্তু এখন স্বয়ং তাদের পার্টি প্রেসিডেন্ট যেভাবে ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিজেপির উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।