বাংলাদেশে শিক্ষা: শিশুদের জেএসসি পরীক্ষার যৌক্তিকতা কী?

  • মিজানুর রহমান খান
  • বিবিসি বাংলা, লন্ডন
বাংলাদেশের একটি গ্রামে পরীক্ষার ফল দেখছেন শিশু শিক্ষার্থীরা।

ছবির উৎস, Najmun Jhumur

ছবির ক্যাপশান,

চট্টগ্রামে হাটহাজারীর একটি গ্রামে পরীক্ষার ফল দেখছেন শিশু শিক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ের কিছু পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন যে তাদের সন্তানরা জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। এই আনন্দটা তারা এভাবে সবার সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চান।

আজ সোমবার জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি এবং প্রাইমারি শিক্ষা সমাপনী বা পিইসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর অভিভাবকদের অনেকই এরকম সুখবর জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।

কিন্তু তারা বলছেন, এই আনন্দের জন্যে ছোট ছোট এসব শিক্ষার্থী, এমনকি তাদেরকেও যে মূল্য দিতে হচ্ছে সেটা বর্ণনাতীত। আর এই মূল্য দিতে হয় একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে যা শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণি থেকে।

অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে ওঠার আগে জেএসসি এবং পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার আগে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরকে পিইসি পরীক্ষা দিতে হয়। জেএসসিতে এবার পাসের হার ৮৬% এবং পিইসিতে প্রায় ৯৮%।

গত কয়েক বছর ধরে এই দুটো পরীক্ষার পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, এত ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে এরকম পরীক্ষায় বসিয়ে তাদেরকে চাপের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ঢাকার তেজগাওয়ে তানিয়া রহমান চৌধুরী, দুই সন্তানের মা। তার ছেলে এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর মেয়ে উঠেছে সপ্তম শ্রেণিতে। তারা দু'জনে পিইসি পরীক্ষাও দিয়েছে। মিসেস চৌধুরী এই দুটো পরীক্ষা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।

"এসএসসি পরীক্ষার ফল দিয়ে বাচ্চারা কলেজে ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় এইচএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে - বুঝলাম। কিন্তু ক্লাস ফাইভের পিইসি আর এইটের জেএসসি সার্টিফিকেট দিয়ে ওরা কী করবে?" জানতে চান তিনি।

"আমার মনে হয় বাচ্চাদেরকে ডিপ্রেশনে আর বাবা-মাকে চাপের মধ্যে রাখার জন্যেই এতো সব পরীক্ষা। আমরাও তো পড়াশোনা করে এসেছি। আমাদের তো এতো পরীক্ষা দিতে হয়নি।"

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পিইসি এবং তার বছর কয়েক পর জেএসসি পরীক্ষা চালু করা হয়।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ভালো ফল করার আনন্দ শিশুদের মুখে।

আরো পড়তে পারেন:

এসব সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অভিভাবকদের একটি অংশের দাবি বহুদিনের। কিন্তু সরকার এগুলো রেখে দেওয়ার পক্ষে। জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ দুটো পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এসব পরীক্ষা শিশুদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।

"যেহেতু ক্লাস ফাইভে একটা পরীক্ষা হচ্ছে, আবার ক্লাস এইটে একটা পরীক্ষা হচ্ছে, আমি জানি, অনেকে এর বিরুদ্ধে কথা বলে। অনেকের আপত্তিও আছে। এই পরীক্ষাটা হওয়ার ফলে ছোট ছোট শিশুদের মাঝে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জেগে উঠছে। গর্বের বিষয় যে তারা সার্টিফিকেট পাচ্ছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার ভয়ভীতিও চলে যায়," বলেন তিনি।

অভিভাবকদের মতো শিক্ষাবিদদেরও একটি অংশ এই দুটো সমাপনী পরীক্ষার বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, এসব পরীক্ষা শিশুদেরকে অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই দুটি সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

অভিভাবকদের চাপের মুখে বছর দুয়েক আগে সরকারের প্রাথমিক ও গণ-শিক্ষামন্ত্রী পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি।

জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য এবং শিক্ষা গবেষক সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে তিনি একমত নন।

"এতো অল্প বয়সের বাচ্চাদের পাবলিক পরীক্ষা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পড়াশোনা হতে হবে খেলাধুলার মতো আনন্দময়। কিন্তু এসব পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্যে শিশুদের ওপর স্কুল এবং তাদের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে যে চাপ দেওয়া হচ্ছে সেটা তাদের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।"

তিনি বলেন, "শিশুদের ওপর যখন তাদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি চাপ দেওয়া হয় তখন সেটা তাদের জন্যে অসহনীয় হয়ে ওঠে। এটা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এতো সব পরীক্ষার কারণে ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে তাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অনীহ হয়ে পড়ছে।"

জেএসসি পরীক্ষার বছরে বাচ্চাদেরকে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৬/৭টি মডেল টেস্টে অংশ নিতে হয়। এসব পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের স্বাভাবিক জীবন।

ছবির উৎস, Najmun Jhumur

ছবির ক্যাপশান,

ফল পাওয়ার পর শিশুদের উল্লাস।

দুই সন্তানের মা মিসেস চৌধুরী বলেন, "ক্লাস এইট মানে সব বন্ধ- বেড়ানো বন্ধ, খেলাধুলা বন্ধ। ক্লাস এইট মানে পরীক্ষা আর পরীক্ষা। ক্লাস এইট মানে শুধু টেনশন আর টেনশন।"

"বাচ্চারা তখন একটা ভয়ের মধ্যে থাকে। এতো চাপ ওরা নিতে পারে না। এভাবে পরীক্ষার গুরুত্বটাই হারিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিতে হয়, তাই দিচ্ছে।"

তিনি জানান, গত বছর তিনি যখন সপরিবারে জাপানে বেড়াতে গিয়েছিলেন তখন তার ছেলেমেয়েরা যেতে রাজি হচ্ছিল না। তাদের আশঙ্কা ছিল যে লেখাপড়ায় তারা পিছিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত তারা গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বাচ্চাদের মুখে 'স্বতঃস্ফূর্ত সেই আনন্দ' আর ছিল না।

তিনি বলেন, এই ভয়ের একটা বড় কারণ জেএসসি পরীক্ষা। কারণ এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে একজন শিক্ষার্থী নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে পারবে কিনা।

কোনো কোনো অভিভাবক আবার এই পরীক্ষার পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো জেএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষার আগের দুই বছরের জন্যে শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেছেন, "এসব পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চাদেরকে শক্ত করে গড়ে তোলা হচ্ছে যেটা তাদের পরবর্তী জীবনের জন্যে সহায়ক হবে। বাচ্চারা কিন্তু পরীক্ষা দিয়েও দিচ্ছে। তারা খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারে, কোন অসুবিধা হয় না।"

শিক্ষা গবেষক সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, ২০১০ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা করার কথা বলা হয়েছিল। সেই রিপোর্ট জাতীয় সংসদেও গৃহীত হয়েছিল।

তখন বলা হয়েছিল এসএসসি পরীক্ষা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু সেটা এখনও না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পরীক্ষার সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে।

মি. রহমান বলেন, "এখন সরকারের ভেতরে এটা নিয়ে কী হচ্ছে সেটা তো আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না।"