মুসলিমদের 'মিঞা কবিতা' নিয়ে আসামে বিতর্ক কেন?
- শুভজ্যোতি ঘোষ
- বিবিসি বাংলা, দিল্লি

ছবির উৎস, Getty Images
মিঞা কবিতার চর্চা হচ্ছে মূলত ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলেই
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে এক বিশেষ ধরনের ডায়ালেক্ট বা উপভাষায় লেখা কবিতাকে ঘিরে সামাজিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
'মিঞা কবিতা' নামে পরিচিত এই কাব্যরীতি বছরকয়েক হল চালু করেছেন ওই রাজ্যের বাংলাভাষী মুসলিমরা, আর এই কবিতাগুলোতে তারা আসামে তাদের সামাজিক বঞ্চনা ও নির্যাতনের ছবিই তুলে ধরছেন।
কিন্তু এই 'মিঞা কবিতা' ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, দিনচারেক আগে এক এই মর্মে এফআইআর দায়ের হওয়ার পর রাজ্য পুলিশ এখন জনাদশেক কবিকে খুঁজছে।
এই কবিরাও সবাই এখন গা ঢাকা দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন।
এদিকে মিঞা কবিদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন আসামের বহু চিন্তাবিদ ও শাসক দল বিজেপির নেতারাও।
ছবির উৎস, Karwan e Mohabbat
মিঞা কবি রেহনা সুলতানা
কিন্তু জাতিস্বত্তার দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ ভারতের এই রাজ্যটিতে 'মিঞা কবিতা' কেন আচমকা এই বিতর্কের কেন্দ্রে?
আসামের বাসিন্দা রেহনা সুলতানা বেশ কিছুদিন হল 'মিঞা কবিতা' লিখছেন, নানা জায়গায় আবৃত্তিও করছেন।
উর্দুতে 'মিঞা' বলতে বোঝায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম ব্যক্তিকে, কিন্তু আসামে এই শব্দটি আসলে একটি বর্ণবাদী গালাগাল - যা অবৈধ অভিবাসী বা বাংলাদেশীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
তবে আসামের বাংলাভাষী কিছু মুসলিম, যারা অনেকেই ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলের বাসিন্দা, এখন তাদের ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয়কে নতুন করে যেন আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন এই মিঞা কবিতার হাত ধরে।
২০১৬তে প্রথম মিঞা কবিতাটি লিখেছিলেন একজন শিক্ষক হাফিজ আহমেদ।
ছবির উৎস, Getty Images
আসামে এনআরসি-র শেষ পর্বের শুনানি আর নথিপত্র পরীক্ষার কাজ চলছে
এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরি করাকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলিমরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তারই প্রতিবাদ ছিল হাফিজ আহমেদের কবিতা।
তারপর এই কবিতা লেখার ধারা দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে, নেলির গণহত্যা থেকে ধর্ষিতা মুসলিম নারীর কাহিনী কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে।
মিঞা কবি হিসেবে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গবেষক শালিম হোসেন।
সেই মি হোসেন বিবিসিকে বলছিলেন, "ইংরেজি-হিন্দির পাশাপাশি বিভিন্ন ডায়ালেক্টেও এই কবিতা লেখা হয়।"
"আর এই ডায়ালেক্টগুলোর উৎস ময়মনসিংহ, পাবনা, ঢাকা - এরকম নানা অঞ্চলে, যার ভেতরে মিশে যায় অসমিয়া ও আরও নানা স্থানীয় ভাষাও।"
ছবির উৎস, Shalim M Hussein/Facebook
মিঞা কবি শালিম হোসেন
"আর এই মিঞা কবিতা চলতে থাকে একটা চেইনের মতো - কেউ হয়তো একটা কবিতা লিখল, তার রেশ ধরে আর একজন লিখল - এইভাবে এগোয়।"
কিন্তু কেন এরা বিশুদ্ধ অসমিয়ায় কবিতা না-লিখে এই ধরনের উপভাষায় কবিতা লিখবেন, আসামের বিশিষ্ট দার্শনিক হীরেন গোঁহাই-এর মতো ব্যক্তিরাও সে প্রশ্ন তুলতে শুরু করার পর মিঞা কবিতার বিরুদ্ধে জনমত তীব্র হয়েছে।
গৌহাটিতে জনৈক প্রণবজিৎ দলই-য়ের করা যে মামলার ভিত্তিতে রাজ্য পুলিশ এখন দশজন মিঞা কবিকে খুঁজছে - তাতেও বলা হয়েছে এই কবিতাগুলো আসামের সামাজিক পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে।
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র অপরাজিতা ভুঁইঞাও বিবিসিকে বলছিলেন, "মিঞারা এই সব কবিতায় সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন। সবাই জানে, এই মিঁয়াদের হাতেই রাজ্যে ধর্ষণ ঘটছে, অপরাধ বেড়ে চলেছে।"
"তবু আমরা ওদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখে থাকি। কিন্তু এরা এতো নির্লজ্জ, বাইরের জগতে একটা ভুল ছবি তুলে ধরার জন্যই এসব আজেবাজে লিখে চলেছে।"
ছবির উৎস, Hiren Gohain/Facebook
আসামের সুপরিচিত চিন্তাবিদ হীরেন গোহাঁই
সদ্য আসাম ঘুরে আসা বিবিসির সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দুবের অভিজ্ঞতাও বলে, "বাঙালি মুসলিমরা যদি গণহত্যা বা ধর্ষণের শিকার হয়েও থাকেন, তাহলে পুলিশে অভিযোগ না করে কবিতায় কেন তা বলা হচ্ছে - আসামে সে প্রশ্ন অনেকেই তুলছেন।"
"কিন্তু মিঞা-রা আবার বলছেন, নিজেদের মনের কথা বলার জন্য এমন একটা দারুণ মাধ্যমকে কেন তারা ব্যবহার করবেন না?"
আসামের তিনসুকিয়া কলেজের বাংলা ভাষা বিভাগের অধ্যাপক সুশান্ত করও মনে করেন, বিষয়বস্তু আর ভাষা - দুই কারণেই আসলে মিঞা কবিতা নিয়ে এত বিতর্ক।
তার কথায়, "এর কনটেন্ট যেমন অহমিয়া শভিনিজমকে চ্যালেঞ্জ করছে, তেমনি এর ভাষার মধ্যেও লুকিয়ে আছে আসামের ভাষা রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।"
"আসামের এই তথাকথিত মিঞারা একটা সময় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তারা অসমিয়া হয়েই আসামে থাকবে।"
ছবির উৎস, Getty Images
আসামের কামরূপে বাঙালি মুসলিম নারীরা
"ফলে ময়মনসিংয়ের বাংলা ডায়লেক্ট-কেও অসমিয়ারই একটা ডায়লেক্ট বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যদিও ভাষাগতভাবে তার কখনওই কোনও ভিত্তি ছিল না।"
"রাজনৈতিক স্বার্থে অসমিয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেখানোর জন্য এটা করা হয়েছিল বটে, কিন্তু এই বাংলাভাষী মুসলিমরা মন থেকে এটা কোনও দিনই মেনে নেননি।"
ফলে আজ এত বছর পরে নিজস্ব ভাষা বা জুবান নিয়ে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভই মিঞা কবিতার রূপে বেরিয়ে আসছে বলে অধ্যাপক কর মনে করেন।
এদিকে এ মাসের শেষেই আসামে প্রকাশ হতে যাচ্ছে বিতর্কিত এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা, যাতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি মুসলমান ভারতের নাগরিকত্ব খোয়াতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সেই তালিকা প্রকাশের ঠিক আগে মিঞা কবিতা নিয়ে বিতর্ক উত্তেজনাকেই আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।