সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: বিবিসি বাংলার জরিপে ১৩ নম্বরে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম একজন পথিকৃৎ সত্যজিৎ রায়।
দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ১৩ তম স্থানে আসেন চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আজ তাঁর জীবন-কথা।
আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি জগতের একটি বিরল প্রতিভা সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র পরিচালনায় তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্য এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল।
হয়ত এটা বললে ভুল হবে না যে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারণেই আজ বাংলা ভাষায় তৈরি চলচ্চিত্র পৃথিবী জুড়ে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই বলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির মাধ্যমে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে।
তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন সুপরিচিত লেখক, চিত্রকর ও দার্শনিক। সেসময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তাঁর নিজের একটি ছাপাখানাও ছিল।
ছবির উৎস, Calcutta State Archive
সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুপরিচিত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও মা সুপ্রভা দেবী। শিশু বয়সে বাবাকে হারানোর পর মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ রায়।
কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের দোসরা মে। উত্তর কলকাতার ১০০ নম্বর গড়পাড় রোডে কাটে তাঁর শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর।
বাবা ছিলেন অন্যতম সেরা শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়। মা সুপ্রভা দেবী। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান।
এর দু-তিন বছরের মধ্যে তাঁরা চলে আসেন তাঁর মামার বাড়িতে দক্ষিণ কলকাতার বকুলবাগানে। সেখানে যাবার পর বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তিনি ভর্তি হন। মায়ের সান্নিধ্যেই বড় হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ রায়।
চলচ্চিত্র প্রাবন্ধিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য বলেছেন অসাধারণ এক বাল্যকাল পার করেছিলেন সত্যজিৎ।
"সেই ছেলেটি সারাক্ষণ নানা দিক থেকে সমানে তৈরি করেছেন নিজেকে। শুধু পড়াশোনায় নয়, গানবাজনা, ছবি আঁকায় নিজেকে দক্ষ করে তোলা- এরকম একটা অর্গানাইজড বয়হুড (সুশৃঙ্খল বাল্যকাল) ভাবা যায় না।"
"এর মধ্যে ওঁনার বড় একটা অনুপ্রেরণা ছিলেন মা সুপ্রভা দেবী। মা ছেলের এই সম্পর্কের দিকটা পরে সত্যজিৎ রায় অনেকটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর 'অপরাজিত' ছবিতে," বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
ছবির উৎস, Getty Images
অর্থনীতি আর চারুকলা নিয়ে পড়লেও চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর বাকি জীবনের ইতিহাস। কলকাতায় 'সোনার কেল্লা' ছবির শ্যুটিং।
১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন সত্যজিৎ রায়। এরপর মায়ের একান্ত ইচ্ছায় শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যান চারুকলা নিয়ে।
এসময় শিক্ষক হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার দুই দিকপাল আচার্য নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়কে।
১৯৪৩ সালে কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দেন ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি.জে. কিমারে। সেখানে তিনি বিজ্ঞাপন ডিজাইনের কাজ করতেন।
একইসময়ে তিনি প্রকাশনা সংস্থা 'সিগনেট প্রেস'-এর সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে তিনি প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন। যার মধ্যে রয়েছে জীবনানন্দ দাসের 'বনলতা সেন' ও 'রূপসী বাংলা'র প্রচ্ছদ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়' এবং জওহরলাল নেহেরুর 'ডিসকভারি অফ ইণ্ডিয়া'সহ বহু বইয়ের প্রচ্ছদ।
কিন্তু চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে দেয় তাঁর বাকি জীবনের ইতিহাস।
ছবির উৎস, Getty Images
ভিত্তোরিও ডি সিকোর ছবি 'বাইসাইকেল থিভস্' সত্যজিৎ রায়ের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার স্ত্রী বলেন ওই ছবি দেখেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন চলচ্চিত্রকার হবেন।
উনিশশ পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে লন্ডন সফরের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্র জগতে তাঁর জয়যাত্রা। কলকাতায় সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপিকা এবং চলচ্চিত্র সমালোচক সুনেত্রা ঘটক বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন ওই যাত্রাটা সত্যজিৎ রায়ের জীবনের জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
"তখন তিনি জাহাজে করে বিদেশ যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ডি.জে.কিমার ও সিগনেট প্রেসের 'আম আঁটির ভেঁপু' বইটির প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশনের কাজটা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। ওটা যখন করছেন, তখনই, আমার যেটা মনে হয়, ওঁনার ছবি করার একটা কথা মাথায় এসে থাকতে পারে। তখন তিনি পাতায় পাতায় ছবি আঁকছেন। ভিস্যুয়ালগুলো ভাবছেন।"
জানা যায় লন্ডনে ডি.জে.কিমারের সদর দপ্তরে কাজ করার সময় সত্যজিৎ রায় তিন মাসে ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন।
"ওখানে গিয়ে উনি প্রচুর ছবি (সিনেমা) দেখেছিলেন। তার মধ্যে যে ছবিটি ওঁনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, সেটি হচ্ছে ইটালীয় পরিচালক ডি সিকার ছবি বাইসাইকেল থিভস্। এই ছবিটি তিনি দেখেন অনেকবার এবং সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় আমাকে বলেছেন, ওই ছবিটা দেখার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে তিনি চলচ্চিত্রকার হবেন," জানান সুনেত্রা ঘটক।
সুনেত্রা ঘটক বলেন, লন্ডনে যাবার পথে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালি'র শিশুতোষ সংস্করণ 'আম আঁটির ভেঁপু'র ভিস্যুয়াল তৈরির কাজ তিনি শেষ করে ফেলেছিলেন। আর জাহাজে দেশে ফেরার পথে তিনি 'পথের পাঁচালি'র স্ক্রিপ্টও তৈরি করে ফেলেন।
ছবির উৎস, Getty Images
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালি' তাঁকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে পরিচিত করে তোলে।
আম আঁটির ভেঁপু বইয়ের জন্য তাঁর আকা ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র পথের পাঁচালিতে।
তাঁর এই বিশ্বনন্দিত ছবিটি বানানোর জন্য তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন কিছু কলাকুশলীকে একত্রিত করেছিলেন। নিজের জমানো অর্থ খরচ করে ছবির শ্যুটিং শুরু করেছিলেন। আর্থিক সহায়তার অভাবে ছবিটির দৃশ্যগ্রহণ চলে দীর্ঘ তিনবছর ধরে।
পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবি তৈরির কাজ শেষ করেন সত্যজিৎ রায় এবং সেই বছরই ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে ও বহু পুরস্কার জিতে নেয়। দেশে বিদেশে ছবিটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
মানুষের জীবন নিয়ে তাঁর সংবেদনশীলতাকে তিনি তাঁর ছবিতে ভাষা দিয়েছেন। তাঁর ক্যামেরা দিয়ে তিনি জীবনের নানা ছবি এঁকেছেন।
তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একজন মানুষ এবং তাঁর সেই সম্পূর্ণতাকে পাওয়া যায় তাঁর ছবিগুলোতে।
মোট ৩২টি কাহিনি চিত্র এবং চারটি তথ্য চিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
১৯৫৫ সাল থেকে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান অস্কার পান তিনি ১৯৯২ সালে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়, অনেক ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্মে শিশু কিশোরদের জন্য একটা বিশেষ জায়গা ছিল। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। একটি হল গোয়েন্দা ফেলুদা, অন্যটি বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু।
চলচ্চিত্র প্রাবন্ধিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য মনে করেন একটা সংস্কৃতিতে এরকম একজন মানুষের জন্ম নেহায়েতই বিরল একটি ঘটনা।
"তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ একজন মানুষ এবং তাঁর সেই সম্পূর্ণতাকে পাওয়া যায় তাঁর ছবিগুলোতে। সব বিষয়ে তাঁর অসামান্য একটা দখল ছিল। তিনি মিউজিক জানতেন, এডিটিং জানতেন, স্ক্রিপটিং জানতেন, ডিরেকশন তো জানতেনই। ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি জানতেন। এই যে একটা ছবিকে সম্পূর্ণ নিজের মত করে করা -ছবি তৈরির সবদিকে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেলে দেওয়া- এটা বিরল।"
"আর এতরকমের ছবি! ভারতবর্ষের মত এত বিরাট একটি দেশকে একজন লোক ৩২টি ছবির মধ্যে দিয়ে তুলে ধরছেন। কোন একটি ছবিকে আপনি ফেলতে পারবেন না," বলেন মি: ভট্টাচার্য।
ছবির উৎস, Getty Images
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায় শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা নয়, তাঁর অনেক ছোট গল্প ও উপন্যাসও পাঠকসমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
মি: ভট্টাচার্য বলেন এসব কারণেই তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন না বলে কোন উপায় নেই।
একাত্তর বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান ঘটে কলকাতায় ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিলে।