সৌদি আরব: যুবরাজ মোহাম্মদকে চ্যালেঞ্জ করছে যে বেদুইন যোদ্ধা গোষ্ঠী

ছবির উৎস, Frank Gardner
বনি আল হুয়েইতির কজন সদস্য।
লন্ডন-প্রবাসী সৌদি আরবের একজন মানবাধিকার কর্মী অভিযোগ করছেন, তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। আর তার বিশ্বাস, এই হুমকি দিয়েছে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুচরেরা।
আলিয়া আবুতায়া আলহুয়েইতি নামের এই নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন, ফোন এবং টুইটের মাধ্যমে তাকে এসব হুমকি দেয়া হয়েছে।
কারণ, লোহিত সাগরের পারে চোখ ধাঁধানো এক আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর শহর গড়ে তোলার ব্যাপারে সৌদি সরকারের পরিকল্পনায় তার গোত্র বাধা দেয়ার পর তিনি এই বিরোধিতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছিলেন।
"তোমাকে আমরা লন্ডনে ধরতে পারবো," মিস আলহুয়েইতি তার টেলিফোন কলের হুমকি সম্পর্কে বলছিলেন, "তুমি ভাবছো সেখানে তুমি নিরাপদ রয়েছে। কিন্তু তুমি নিরাপদ নও।"
মিস আলহুয়েইতি জানান, তাকে যে হুমকি দেয়া হয় তাতে বলা হয়, "জামাল খাশোগজির ভাগ্যে যা ঘটেছে, তোমার ভাগ্যেও তাই ঘটবে।"
এরপরই তিনি এই হুমকির বিষয়টি লন্ডনের পুলিশকে জানিয়েছেন।
সাংবাদিক এবং সৌদি যুবরাজের কর্মকাণ্ডের একজন কড়া সমালোচক জামাল খাশোগজিকে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটের ভেতরে সরকারি এজেন্টরা খুন করে এবং তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কেটে ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিশ্বাস, এই খুন হয়েছিল যুবরাজ মোহাম্মদের আদেশে। সৌদি সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
ছবির উৎস, YouTube
মারা যাোয়ার আগে আব্দুল রহিম আল-হুয়েইতি বলেছিলেন, সরকার তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।
গত ১৩ই এপ্রিল আব্দুল রহিম আল-হুয়েইতি নামে এক ব্যক্তি অনলাইনে একটি ভিডিও পোস্ট করেন।
এতে তিনি অভিযোগ করেন যে 'নিওম' নামে নতুন এক উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নিরাপত্তা বাহিনী তার এবং তার গোত্রের লোকজনকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে।
একই গোত্রের সদস্য আলিয়া আলহুয়েইতি ঐ ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ঐ ভিডিওতে আব্দুল রহিম আল-হুয়েইতি জানান, সরকারের উচ্ছেদ আদেশকে তিনি মেনে নেবেন না।
ভিডিওতে তিনি এক জায়গায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে তাকে দোষী বানানোর লক্ষ্যে নিরাপত্তা বাহিনী হয়তো তার বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র রেখে আসবে।
এর পরপরই তিনি সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক বিবৃতিতে তার মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হলেও বলা হয় যে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি ছুঁড়েছিলেন এবং তারা বাধ্য হয়েই পাল্টা গুলি চালায়।
মিস আলহুয়েইতি এই বিবৃতিকে নাকচ করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, মি. আল-হুয়েইতির কাছে কোন অস্ত্র ছিল না।
গত বুধবার তিনি অনলাইনে কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ পোস্ট করেছেন যেখানে আল-খোরাইবা গ্রামে মি. আল-হুয়েতির জানাজার দৃশ্য দেখা গেছে।
ছবির উৎস, AFP
নিওম প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জায়গা। এটাই বিন আল-হয়েইতির আবাসভূমি।
আল হোয়েইতাত আরব বেদুইনদের একটি গোত্র যারা তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে খুবই গর্বিত।
অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে এদের নাম লেখা রয়েছে। এই গোত্রটি ১৯১৭ সালের আরব বিদ্রোহের সময় টি. ই. লরেন্স (লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া)-র পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল।
এখন আল হোয়েইতাত-এর বেশিরভাগ সদস্যই মরুভূমির যাযাবর জীবন ত্যাগ করে নিজেদের গ্রামে বসবাস করছেন।
"তারা নিওম উন্নয়ন প্রকল্পের বিরোধী না," বলছেন আলিয়া আবুতায়া আলহুয়েইতি, "তারা যেটা চাইছেন সাতপুরুষের ভিটেমাটি থেকে তাদের যেন উচ্ছেদ করা না হয়।"
তিনি জানান, সরকারি উচ্ছেদের প্রতিবাদ করার দায়ে আব্দুল রহিম আল-হুয়েইতির সাতজন চাচাতো ভাইকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
এরা চাইছেন পশ্চিমা মানবাধিকার কর্মীদের সহায়তায় সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে আইনগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে।
কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদে সৌদি আরবের তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চান। তার জন্য তিনি গড়ে তুলতে চান আধুনিক শহর।
ছবির উৎস, AFP
২০১৭ সালে বিনিয়োগকারীদের এক সম্মেলনে প্রিন্স মোহাম্মদ নিওম প্রকল্পটির বিস্তারিত প্রকাশ করেন।
বিবিসি বাংলায় আরও খবর:
কিন্তু এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনায় বিরোধিতা করার জন্য একজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু তার জন্য প্রথম কোন সমস্যা না।
জামাল খাশোগজির মৃত্যুর ঘটনায় সৌদি রাজতন্ত্রের ওপর আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসের ভিত্তি অনেকখানি টলে গিয়েছে।
পাশাপাশি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যাকে মনে করা হয় রাজত্বের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তার সম্পর্কেও তৈরি হয়েছে সন্দেহ।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের জন্য বিশ্ব অর্থনীতি তছনছ হয়েছে এবং তেলের বাজার দারুণভাবে মার খেয়েছে।
নিওম প্রকল্প নিয়ে সৌদি সরকারের প্রচার বিজ্ঞাপন:
এখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি না ঘটলে সৌদি আরব কীভাবে নিওম প্রকল্পে চার লক্ষ কোটি ডলার ব্যয় করবে তা পরিষ্কার নয়।
তবে রোববার সৌদি সরকারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে যে এই প্রকল্প ঠিকঠাক চলছে। এবং ২০৩০ সাল নাগাদ প্রথম শহরটি তৈরি হয়ে যাবে।
তবে জুলুম করে উচ্ছেদ, বিক্ষোভকারীর সন্দেহজনক মৃত্যু এবং হুমকি-ধমকির ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এই প্রকল্পের ভাবমূর্তি কীভাবে উজ্জ্বল করবে তা বোঝা যাচ্ছে না।
আর প্রকল্পটি আদৌ শেষ হবে কিনা তা নিয়েও এখন তৈরি হয়েছে গভীর সন্দেহ।