বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলা: যেভাবে সংগঠিত হয়েছিল জেএমবি
- সায়েদুল ইসলাম
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস, Getty Images
ঢাকায় একটি জঙ্গি আস্তানায় র্যাবের অভিযান (ফাইল ফটো)
দু'হাজার পাঁচ সালের ১৭ই অগাস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়েছিল। ওই হামলায় দুই জন নিহত আর বহু মানুষ আহত হন।
একযোগে হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির ঘোষণা করেছিল জঙ্গিরা। সেদিন নিজেদের একটি প্রচারপত্র বা লিফলেটও ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরবর্তীতে জানায়, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের একটি জঙ্গি গোষ্ঠী ওই হামলা করে।
কিন্তু কীভাবে একযোগে দেশজুড়ে হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল এই জঙ্গি সংগঠনটি? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাই বা তখন কেমন ছিল?
নিজেদের উপস্থিতির ঘোষণা
পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্লেষক ও জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করেন, এমন ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৫ সালের আগে থেকেই জঙ্গিরা নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। কিন্তু সেসব বিষয় ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়নি। জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''২০০৫ সালের ১৭ই অগাস্ট যখন ৬৩ জেলায় বম্বব্লাস্ট হলো, তখন জঙ্গিরা ছিল খুবই সুসংগঠিত। কারণ এই ধরণের হামলার ইতিহাস পৃথিবীতে নাই যে, একসঙ্গে একটা দেশের এতগুলো জায়গাতে সমন্বিতভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। তারা চেয়েছিল, নো ক্যাজুয়ালটির মাধ্যমে নিজেদের জানান দেবে। এতো পরিকল্পিত সমন্বিত হামলার ইতিহাস পৃথিবীতে নাই।''
''আমরা দেখেছি, একটা দেশের অধিকাংশ জায়গায়, ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় হামলা করার মতো তাদের সাংগঠনিক কাঠামো, সক্ষমতা, গোপন রাখার প্রক্রিয়া - সেগুলো তাদের ছিল।''
আরো পড়ুন:

ছবির উৎস, Getty Images
২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট বোমা হামলার পর জঙ্গিবাদ বিরোধী সমাবেশে পুলিশের তল্লাশি
জঙ্গিদের সংগঠিত হয়ে ওঠা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জেএমবির বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রেপ্তার হওয়ার জঙ্গিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গঠিত হয় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা আমির শায়খ আবদুর রহমান গ্রেপ্তারের পর জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়েছেন।
তারা বাংলাদেশকে ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। পরে তারা দাওয়াত ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে তাদের সংগঠনের প্রচার প্রচারণা শুরু করে। এভাবেই সারা দেশে তারা কর্মী সংগ্রহ শুরু করে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় তাদের কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই বছর দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে কর্মী সংগ্রহ করে জেএমবি। এরপর তারা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে।
২০০০ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-আরএসও ক্যাম্পে জেএমবির প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নথিপত্রের বরাত দিয়ে গবেষক নুরুজ্জামান লাবু বলছেন, জেএমবি প্রথম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে ২০০১ সালে। ওই বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর তারা সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে।
পরের বছর ২০০২ সালে পহেলা মে নাটোরের একটি সিনেমা হলে, একই বছরের সাতই ডিসেম্বর ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা করা হয়।
কিন্তু সেই সময় তৎকালীন সরকার এসব হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে দেয়।
নুরুজ্জামান লাবু বলছেন, ''জঙ্গিদের পরবর্তী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন নেতা পৃষ্ঠপোষকতা করতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।''
জঙ্গি কর্মকাণ্ডের একজন পর্যবেক্ষক নূর খান লিটন বলছেন, ''২০০৫ সালের ১৭ অগাস্টের আগে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। যেমন রমনা বটমূলে বোমা হামলা, আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়গুলোকে- এগুলো যে জঙ্গি গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ হামলা, এই বিষয়টি তাদের গোচরীভূত হয়নি। এই ব্যাপারে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন না।''
''আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তখন রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করতেন, তারা হয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেননি, অথবা তারা এর সুবিধা নিতে চাইছিলেন।''
জেএমবির আরেক নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই রাজশাহী ও নওগাঁ জুড়ে তাণ্ডব চালালে আলোচনায় উঠে আসে। তখন তারা নিজেদের জাগ্রত মুসলিম জনতা বা জেএমবি বলে পরিচয় দিতো। সেই সময় 'বাংলা ভাই' মিডিয়ার সৃষ্টি বলে মন্তব্য করেছিলেন বিএনপি-জামাত নেতৃত্বাধীন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০৫ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি জেএমবি ও জেএমজেবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ করা হলেও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
গবেষক ও সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবু বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় বোমা তৈরি করে, সেসব বোমা এক জেলা থেকে আরেক জেলায় সরবরাহ করে সিরিজ হামলা করতে সক্ষম হয়েছিল জঙ্গিরা।
ফলে এই জঙ্গিরা নিজেদের কর্মী সংগ্রহ, বোমা তৈরি, পরিবহন, পরিকল্পনা ইত্যাদি করে গেলেও সেই সময় তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল। এই হামলার ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে আগাম কোন তথ্যও ছিল না।

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশে এখনো মাঝেমাঝে জঙ্গিরা সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলে পুলিশ জানিয়েছে
কীভাবে চোখের আড়ালে তারা সংগঠিত হলো?
বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলছেন, ''আমি তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না বা এই বিষয়ে কাজ করতাম না।''
''কিন্তু এই বিষয়ে আমার গত কয়েক বছরের পেশাদারি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,তখন যারা এই বিষয়গুলোয় কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদাসীন্য ছিল, ব্যর্থতা ছিল।''
''এবং আমরা দেখেছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন এর আগে ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেখানে আমরা দেখেছি, সরকারের কোন কোন মহলের পৃষ্ঠপোষকতা বা ডিনায়াল প্রসেস কাজ করেছিল বলে আমার বিশ্লেষণ।''
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান
২০০৫ সালের ওই বোমা হামলার ঘটনার পর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কিছুটা শক্ত অবস্থান নেয় তৎকালীন সরকার।
সেই সময় ৬৩টি জেলায় ১৫৯টি মামলা হয়। তবে গত ১৫ বছরেও তার মধ্যে ৪৭টি মামলার এখনো সুরাহা হয়নি।
তবে ২০০৫ সালের ১৪ই নভেম্বর ঝালকাঠিতে জঙ্গিদের বোমা হামলায় দুইজন বিচারক নিহত হওয়ার মামলায় পরবর্তীতে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই মামলাতেই ২০০৬ সালের ৬ই মার্চ সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। ২০০৬ সালের ১৬ই অক্টোবর এদের একজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালের ২৯শে মার্চ মধ্যরাতে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।