শিশু নির্যাতন: মাদ্রাসায় ছাত্র নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল, অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেফতার

  • সাইয়েদা আক্তার
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
দুটি মানুষের ছায়া

ছবির উৎস, tzahiV

*** সতর্কতা: এই প্রতিবেদনের কিছু কিছু অংশ আপনার কাছে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে

ছেলের জন্মদিনে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন এক মা। ছেলেটি থাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার এক মাদ্রাসায়। আধ ঘণ্টার মত ছেলের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মা যখন ফিরছেন, আট বছরের শিশুটি তখন মায়ের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু মাদ্রাসার এক শিক্ষক শিশুটির ঘাড় ধরে ফিরিয়ে আনেন তাকে, ঠেলতে ঠেলতে ঢোকান এক কক্ষে, তারপর তাকে নৃশংসভাবে পেটাতে শুরু করেন।

হাটহাজারী মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমিতে মঙ্গলবার বিকেলে ঘটে যাওয়া এই শিশু নির্যাতনের ঘটনাটি ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ বুধবার অভিযুক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে।

মঙ্গলবার রাতেই চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ওই শিশুটিকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে আসেন, আটক করা হয় নির্যাতনকারী শিক্ষককেও, কিন্তু শিশুটির মা-বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে রাজি না হওয়ায় প্রশাসন পরে ওই শিক্ষককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

হাটহাজারির পুলিশ বলছে, পরে ছেলেটির মা একটি মামলা দায়ের করলে ওই শিক্ষককে তারা গ্রেফতার করেছেন।

এর আগে অভিযুক্ত শিক্ষকের সাথে কথা বলে বিবিসি জানতে পেরেছে, বুধবারই তাকে মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

আরো পড়তে পারেন:

যা ঘটেছিল:

ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া তেত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, লম্বা সাদা আলখাল্লা পরা এক ব্যক্তি ছোট্ট একটি শিশুকে ঘাড়ের কাছের কাপড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছেন। শিশুটির পরনে হালকা গোলাপি পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর সাদা গোল টুপি।

কয়েক পা যাওয়ার পর শিশুটিকে একটি ঘরে ঢোকানো হয়। এরপর শিশুটিকে মাটিতে ফেলে বেত দিয়ে পেটাতে শুরু করেন ওই ব্যক্তি।

শুরুতে শিশুটির ডান হাত ধরে পেটানো হয়, এক পর্যায়ে শিশুটি মাটিতে শুয়ে পড়ে।

তখন তার ডান পা টেনে ধরে পায়ের ওপর পেটাতে থাকে ওই শিক্ষক।

ভিডিওটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। তবে হাটাহাজারি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বিবিসিকে বলেছেন, ভিডিওটি দেখেই শিশুটিকে এবং অভিযুক্ত শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়েছে এবং ভিডিওটি যে মঙ্গলবারই ধারণ করা হয়েছে সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

শিশুদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন, হয়রানি ও নির্যাতন করার বিকৃতিকে 'পেডোফিলিয়া' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়

অভিযোগ করতে চাননি অভিভাবক

মি. আমিন বিবিসিকে বলেন, মঙ্গলবার রাতে ভাইরাল ভিডিওটি দেখে তিনি রাত একটার দিকে পুলিশ নিয়ে হাটহাজারীর মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমী নামে ওই মাদ্রাসাটিতে যান।

সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার শিশু, অভিযুক্ত শিক্ষক এবং মাদ্রাসার পরিচালককে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। এর পর শিশুটির মা-বাবাকে ডেকে আনা হয়।

মা-বাবাকে ভিডিওটি দেখানোর পর মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

কিন্তু তারা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোন অভিযোগ দিতে চান না, তাকে কোন সাজা দিতে চান না।

মি. আমিন বলেন, "মামলা দায়ের করার জন্য তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শিশুটির মা-বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি আমরা।

এমনকি আজ সকালেও শিশুটির বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি, তখনো তাদের বলেছি, কিন্তু তারা কিছুতেই মামলা করবে না শিক্ষকের বিরুদ্ধে।"

শিশুটির মা-বাবা মামলা করতে রাজি তো হনই নি, বরং নির্যাতনের শিকার শিশুর মা-বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছেন রাতেই, যেখানে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিতে আবেদন জানানো হয়েছে।

ফলে রাত সাড়ে চারটায় ওই শিক্ষকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে শিশুটির মা-বাবার জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয় প্রশাসন।

কিন্তু বুধবার রাতে স্থানীয় পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে যে শিশুটির মা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন এবং তারপর ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

শিশুটির অভিভাবকের বক্তব্য

এর আগে শিশুটির বাবা মোহাম্মদ জয়নাল বিবিসিকে বলেছেন, তার সন্তানকে মারধরের ঘটনায় তিনি ও তার স্ত্রী অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন।

কিন্তু শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে চান না তিনি।

কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "ছেলেকে হাফেজী পড়াইতে চাই আমরা, সে তো ওইখানে পড়বে, তাইলে মামলা করে কী হবে? উল্টা শিক্ষকের জীবনটা নষ্ট হবে।"

মাদ্রাসা শিক্ষক কী বলছেন?

ভিডিওচিত্রে যে ব্যক্তিকে নির্যাতনকারীর ভূমিকায় দেখা গেছে, তার সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।

তিনি মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে ওই মাদ্রাসার হিফয শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া।

গত তিন মাস ধরে এই আবাসিক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন।

তবে বুধবার সকালে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করেছে বলে তিনি জানান।

গ্রেফতার হওয়ার আগে বিবিসিকে তিনি বলেন, নির্যাতনের ঘটনায় তিনি শিশুটির মা-বাবার কাছে তিনি মাফ চেয়েছেন।

মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, জন্মদিনে শিশুটির মা ছেলের জন্য মিষ্টি ও চকলেট নিয়ে এসেছিলেন। এমনকি তাকে (মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে) নাস্তা খাওয়ার জন্য মা দুইশো টাকাও দিয়েছিলেন। এরপর মা যখন চলে যাচ্ছেন, সেসময় শিশুটি দৌড়ে মাদ্রাসার বাইরে বেরিয়ে রাঙ্গামাটি-হাটহাজারী চৌরাস্তায় চলে যায়।

শিশুটিকে ফিরিয়ে আনতে আনতে তিনি (মোহাম্মদ ইয়াহিয়া) রেগে গিয়েছিলেন বলে বিবিসিকে জানান।

"আসলে যে রকম দেখা যাচ্ছে, অত জোরে মারতে ছিলাম না, বেতটাও হাফ বেত, এক বিঘতের চেয়ে একটু বড় সাইজ। বেশি জোরে লাগে না। কিন্তু আমার অন্যায় হইছে, ওইভাবে মারা উচিত হয় নাই।" বলেন মি. ইয়াহিয়া।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশে মাদ্রাসাগুলোয় প্রায়ই শিশু নিপীড়নের অভিযোগ শোনা যায়

রাষ্ট্র কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না

এই ধরণের নির্যাতনের ঘটনায় পরিবার অভিযোগ না করলে রাষ্ট্র কি ব্যবস্থা নিতে পারে?

এ প্রশ্নের জবাবে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেছেন, "মোবাইল কোর্ট হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু শিশু নির্যাতনের মামলা হলে সেটা যাবে শিশু ট্রাইব্যুনালে।

এখন মামলা করতে হলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ লাগবে, এমনকি পুলিশ মামলা করলেও আদালতে সংক্ষুব্ধ পক্ষের অভিযোগ জানাতে হবে। কিন্তু পরিবার তো অভিযোগ করতে চাচ্ছে না।"

চট্টগ্রাম হাটহাজারীর মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি একটি আবাসিক হাফেজী মাদ্রাসা।

এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন তিন হাজার টাকা, এর মানে হচ্ছে এখানে যারা পড়ছেন তারা একেবারে বিত্তহীন পরিবার থেকে আসা মানুষ নন।

বাংলাদেশে আবাসিক মাদ্রাসাগুলোতে প্রায়ই শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থীদের নির্মম মারধরের শিকার হতে হয় এমন অভিযোগ রয়েছে।

এমনকি শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শারীরিক নিপীড়ন ও বলাৎকারের শিকার হন এমন অভিযোগও শোনা গেছে।

তবে এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে মামলা দায়ের কিংবা শাস্তি পাওয়ার ঘটনা প্রায় কখনোই শোনা যায় না।