তালেবান: হিবাতুল্লাহ আকুন্দযাদা ও আবদুল গনি বারাদার ছাড়া শীর্ষ নেতৃত্বে আর কারা রয়েছেন, কে কোথায় আছেন?

ছবির উৎস, Getty Images
আফগানিস্তানের তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা যে চারজন ব্যক্তি তাদের একজন হচ্ছেন মোল্লাহ আব্দুল গনি বারাদার (মাঝে)
আফগানিস্তানে ফিরতে শুরু করেছেন তালেবানের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা।
মঙ্গলবার কান্দাহারে ফিরেছেন তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং জ্যেষ্ঠ নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। তিনি তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়েরও প্রধান।
এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কোন দেশে থেকে ফিরেছেন। তবে তালেবানের বেশিরভাগ নেতা কাতারের রাজধানী দোহায় ছিলেন। সেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে আলোচনা করছিলেন।
কান্দাহার শহরটি তালেবানের আধ্যাত্মিক জন্মস্থান। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী তাদের বিতাড়িত করার আগে পর্যন্ত এই শহরটি ছিল তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কান্দাহার বিমানবন্দর থেকে যখন মোল্লাহ আবদুল গনি বারাদার গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন, তখন, উচ্ছ্বসিত জনতা তাকে অভিবাদন জানায়।
জাবিউল্লাহ মুজাহিদকে প্রথম দেখলেন সাংবাদিকেরা
তালেবান আফগানিস্তানের দখল নেবার পর সোমবার তাদের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, তারা সরকার গঠনের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
ছবির উৎস, Reuters
দশ বছর ধরে সাংবাদিকেরা জাবিউল্লাহ মুজাহিদের কণ্ঠ শুনে এলেও এই প্রথম তাকে সামনাসামনি দেখলেন। অনেক সাংবাদিকই এতদিন ধন্দে ছিলেন যে, জাবিউল্লাহ মুজাহিদ কি একজন ব্যক্তি নাকি কয়েকজন ব্যক্তি এই নামটি ব্যবহার করে সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন?
এই প্রথম জনসমক্ষে এসে বক্তব্য দিলেন তালেবানের এই নেতা। এর আগে এই নেতারা বক্তব্য ও বিবৃতি পেত সংবাদমাধ্যম। কিন্তু সোমবার তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অনেক প্রশ্নেরও জবাব দেন।
"সব পক্ষ, সব গোষ্ঠী, সবার অন্তর্ভুক্তি আমরা নিশ্চিত করব, কাজ সম্পূর্ণ হলে আমরা সরকার ঘোষণা করব," বলেছেন মি. মুজাহিদ।
"সরকার গঠনের পর সব কিছু পরিষ্কার হবে," তিনি জানান।
"সরকার গঠনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নেব এবং দেশের জনগণকে জানাব দেশ কোন আইনে চলবে," বলেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।
"আমি স্পষ্ট বলতে চাই সরকার গঠনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের কাজ সম্পূর্ণ হলে আমরা এ বিষয়ে ঘোষণা দেব।"
তালেবানের নতুন সরকারে কে কে থাকছে, কে হবেন সরকার প্রধান তার সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা এখনো আসেনি। তবে তালেবানের নেতাদের সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে:
১. হিবাতুল্লাহ আকুন্দযাদা
তালেবান নেতা আখতার মানসুর মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ২৫শে মে থেকে তিনি তালেবানের সুপ্রিম কমান্ডারের দায়িত্বে রয়েছেন।
আশির দশকে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে সামরিক নেতার তুলনায় একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে তার পরিচিতি বেশি।
ছবির উৎস, Getty Images
হিবাতুল্লাহ আকুন্দযাদা
হিবাতুল্লাহ আকুন্দযাদা ১৯৯০ এর দশকে শরিয়া আদালতের প্রধান ছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতায় আসার তালেবান শরিয়া আইন অনুযায়ি বিচার ব্যবস্থা ও শাস্তির প্রচলন করে। তারা প্রকাশ্যে খুনী ও ব্যাভিচারীদের হত্যা করতো। চুরির অপরাধে অঙ্গহানী করতো।
মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের (২০১৩ সালে তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা) নেতৃত্বে তালেবান টেলিভিশন, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও মেক-আপ নিষিদ্ধ করে। দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করে তারা।
ছবির উৎস, EPA
তালেবান নেতা মোল্লাহ মোহাম্মদ ওমরের খুব বেশি ছবি পাওয়া যায় না, ২০১৩ সালে তিনি মারা যান।
হিবাতুল্লাহ আকুন্দযাদার বয়স ৬০ বছর বলে ধারণা করা হয় এবং জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি আফগানিস্তানে কাটিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তিনি তথাকথিত কোয়েটা শুরার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। এরা মূলত পাকিস্তানের কোয়েটা-ভিত্তিক আফগান তালেবান নেতা।
দলের সুপ্রিম লিডার হিসাবে রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় বিষয়ের প্রধান আকুন্দযাদা।
তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তাকে অবশ্য এখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
২. মোল্লাহ আবদুল গানি বারাদার
১৯৯৪ সালে যে চারজন ব্যক্তি আফগানিস্তানে তালেবান গঠন করেছিলেন, তাদের একজন মোল্লাহ আবদুল গনি বারাদার
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী তালেবানকে উৎখাত করার পর বিদ্রোহীদের নেতায় পরিণত হন তিনি। কিন্তু ২০১০ সালে পাকিস্তানের করাচি থেকে এক পাক-মার্কিন যৌথ অভিযানে ধরা পড়েন।
ছবির উৎস, Getty Images
মোল্লাহ আব্দুল গানি বারাদার দোহা শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন এবং কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায় বসা প্রথম তালেবান নেতা।
আট বছর পর শান্তি আলোচনার জন্য মুক্তি দেয়া হয়। ২০২০ সালে প্রথম তালেবান নেতা হিসাবে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন।
এখন তালেবানের প্রধান রাজনৈতিক নেতা আবদুল গনি বারাদার।
মঙ্গলবার তিনি আফগানিস্তানে ফিরে এসেছেন বলে খবর।
ছবির উৎস, Getty Images
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাতারের দোহায় তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সাথে আবদুল গনি বারাদার।
৩. মোহাম্মদ ইয়াকুব
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা নেতা মোল্লাহ ওমরের সন্তান মোহাম্মদ ইয়াকুব।
তার বয়স প্রায় ৩০ বছর এবং তিনি দলের সামরিক শাখার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
২০১৬ সালে আখতার মানসুরের মৃত্যুর পর তালেবানের একটি অংশ তাকে দলের সুপ্রিম লিডার বানাতে চেয়েছিলেন। তবে অন্যরা তাকে বয়স কম ও অনভিজ্ঞ বলে মনে করেন।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ ইয়াকুব আফগানিস্তানে রয়েছেন।
৪. সিরাজুদ্দিন হাক্কানি
তালেবানের অন্যতম শীর্ষ নেতাদের একজন সিরাজুদ্দিন হাক্কানি।
পিতা জালালুদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর পর তিনি হাক্কানি নেটওয়ার্কের নতুন নেতা হন। আফগান ও পশ্চিমা বাহিনীর ওপর ভয়াবহ সব হামলার জন্য এই দলকে দায়ী করা হয়।
ছবির উৎস, FBI
দেশটিতে এখন হাক্কানি গ্রুপই সবচাইতে ক্ষমতাধর এবং ভীতিকর জঙ্গি গোষ্ঠী
এই এলাকার সবচেয়ে ভয়াবহ ও শক্তিশালী দলগুলোর একটি হাক্কানি নেটওয়ার্ক। অনেকে মনে করেন, আফগানিস্তানের ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর চাইতে এই বাহিনী বেশি ক্ষমতাধর।
এদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমান্তে তালেবানের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পদের দেখভালের দায়িত্বে আছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
সিরাজুদ্দিন হাক্কানির বয়স ৪৫ বছর বলে মনে করা হয়। তার অবস্থান অজানা।
৫. আবদুল হাকিম
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবদুল হাকিমকে দোহা আলাচনার প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে তালেবান।
ধারণা করা হয় তার বয়স ৬০ বছর। পাকিস্তানের কোয়েটায় একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করেন তিনি। এখানে বসেই তালেবানের বিচার বিভাগেরও দেখভাল করেন তিনি।
তালেবানের অনেক জেষ্ঠ্য নেতাই পাকিস্তানের কোয়েটাতে আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন, যেখান থেকে তারা কার্যক্রমও পরিচালনা করেন। এদেরকে 'কোয়েটা শুরা' বলে বর্ণনা করা হয়।
তবে ইসলামাবাদ বরাবরই তথাকথিত এই কোয়েটা শুরার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে।
আবদুল হাকিম তালেবানের সুপ্রিম কমান্ডার হিবাতুল্লাহ আকুন্দজাদার খুবই ঘনিষ্ট একজন নেতা বলে মনে করা হয়।