বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটাসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই, কারণ কী
- রাকিব হাসনাত
- বিবিসি বাংলা, ঢাকা

ছবির উৎস, Getty Images
চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আটা ও ভোজ্য-তেলের দাম বেড়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে
বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেই দাম বেড়েই চলেছে এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, 'আপাতত' এসব পণ্যের দাম কমে আসার সম্ভাবনা কম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এক বছর আগে জাতিসংঘের বিশ্ব ও খাদ্য সংস্থা বাজার পরিস্থিতি এমন হতে পারে বলে অনুমান করেছিলো।
তারা বলছেন, বাজারে পণ্যের কোন ঘাটতি নেই। তারপরেও চাল ছাড়া সব পণ্যের দাম বেড়েছে বা বাড়ছে। সরকার কখনো কখনো কোন পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
"কিন্তু আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়," বলছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
ট্যারিফ কমিশনের সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সদস্য আবিদ খান বলছেন, বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা থাকলে হয়তো দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালে রাখা সরকারের জন্য সহজ হতো।
তবে কোভিড পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা যৌক্তিক কারণেই অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে কিন্তু ধরুন স্টকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকার পরেও পেঁয়াজের দাম বাড়বে কেন। এজন্যই প্রতিযোগিতার দরকার," বলছিলেন তিনি।
ঢাকার হাতিরপুল বাজারে নিয়মিত বাজার করেন রাহেলা সুলতানা। তিনি বলছেন, "এমন কোন পণ্য নাই যার দাম বাড়েনি। সব দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ। কমার কোন লক্ষ্মণও তো দেখিনা।"
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
ছবির উৎস, Getty Images
জাহাজ ও কন্টেইনার ভাড়া অনেক বেড়েছে
বাজারে কোন্ পণ্যের কেমন দাম
ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে প্রতিদিন ভোরে পাইকারি পণ্য কিনে এনে এলাকায় নিজের দোকানে নিয়ে বিক্রি করেন লিটন মিয়া।
তার মতে, সব পণ্যের দামই অনেকে বেড়েছে, তবে চালের মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল।
পাইকারি বাজারে মোটা চাল ৪৪-৪৫ টাকা আর সরু চাল ৫৫-৫৬ টাকায় পাওয়া গেলেও মসুর ডালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
এ মূহুর্তে কম বেশি কেজি প্রতি প্রায় ১২০ টাকা দাম এই মসুরের ডালের। তবে ভারত থেকে আমদানি করার ডালের মূল্য একটু কম।
পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৩০ টাকায় যা দু মাস আগেও ছিলো সাড়ে পাঁচশ টাকার মতো।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ১৯শে অক্টোবর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল সাত টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
আবার আটার দাম এক মাসেই বেড়েছে কেজি প্রতি সাত টাকা, আবার চিনির দাম বেড়ে ঘোরাফেরা করছে ৭৫-৮১ টাকার মধ্যে।
পেঁয়াজের দাম এই বাড়ছে, এই কমছে করেও গত দু মাসে ৪৫-৭০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে।
এ সব পণ্যের পাশাপাশি ডিম, মুরগী ও গরুর মাংসের দামের পাশাপাশি বেড়েছে নানা ধরণের সবজি ও মাছের দামও।
পণ্যের দাম বাড়লে জনসাধারণের কাছে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করে সরকারি সংস্থা টিসিবি।
কিন্তু সেই সরকারি সংস্থা টিসিবি নিজেই সয়াবিন তেল ও মসুর ডালের দাম বাড়িয়েছে কেজি প্রতি যথাক্রমে দশ ও পাঁচ টাকা।
এর আগে গত মার্চেও সয়াবিন তেলের দাম দশ টাকা ও চিনির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়েছিলো সংস্থাটি।
ছবির উৎস, Getty Images
আমদানী করা সব দরকারি পণ্যের দাম বেড়েছে
বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর:
চাল, ডালসহ সব ধরণের পণ্যের ব্যবসা করে সিটি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ সাহা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আবার বাংলাদেশে ডলারের দামও বেড়েছে।
তিনি বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয় বলে আন্তর্জাতিক বাজারের বড় প্রভাব কাজ করে বাংলাদেশের বাজারে।
তবে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে এটি সত্যি। কিন্তু এর সাথে যোগ হয়েছে অতি মুনাফা করার প্রবণতা।
ট্যারিফ কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা আবিদ খান বলছেন, বাজারে প্রতিযোগী খুব কম। ফলে দাম নিয়ে কোন প্রতিযোগিতা হয় না বলেই বাজারের পরিস্থিতি এমন হয়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে দাম বিশেষভাবে বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এগুলো হলো: আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, জাহাজ ও কন্টেইনার খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া।
অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা বলছেন, কোভিড-উত্তর সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক সরবরাহে সংকট দেখা দিচ্ছে বলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।
কিন্তু এ সুযোগে কেউ যেন বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেটি যে কোনভাবে হোক সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি
ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিলো আটশ ডলার যা এ মূহুর্তে চলছে ১৪৮০ ডলার ধরে।
আবার সাড়ে ছয়শ ডলারের পাম অয়েলের দাম এখন ১৩২০ ডলার। আবার ৩০০ ডলারের চিনি বেড়ে হয়েছে ৫১০ ডলার।
আর ২১০ ডলারের গম এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১০ ডলারে।
সিটি গ্রুপের কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ সাহা বলছেন, প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়েছে কিন্তু এসব পণ্যই বাংলাদেশে নিত্য পণ্য।
ব্যবসায়ীরা দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করেন বলে এখানে দাম আরও বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করেন আবিদ খান।
তাই সরকার সবার সাথে আলোচনা করে জনস্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে কিন্তু চাইলেই এতে খুব বেশি কিছু করতে পারে না।
যদিও গোলাম রহমান বলছেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে যতটুকু বাড়লে বাংলাদেশের কতটা বাড়বে তাতে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
"ফলে যে কোন ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে," বলছিলেন তিনি।
ছবির উৎস, Getty Images
বেড়েছে ডলারের দাম
জাহাজ ভাড়ায় ব্যাপক বৃদ্ধি
ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সাথে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে পরিবহন খরচ নিয়ে। বিশেষ করে পণ্য কিনেও চাহিদা মতো জাহাজ ও কন্টেইনার পাওয়া যাচ্ছে না।
এ কারণে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে আমদানীকারকদের।
করোনাকালীন পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ কন্টেইনার আটকে আছে অল্প কিছু বড় বন্দরে। যেগুলো মূলত চীন ও রাশিয়ার হাতে।
ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পণ্য আনার জন্য কন্টেইনার পাওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবিদ খান বলছেন, জাহাজিকরণ নিয়ে এ সমস্যার কারণে আমদানি খচর বাড়ছে।
ডলারের পরিস্থিতি
বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং খোলা বাজার উভয় জায়গাতেই টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে চলেছে।
এই মূহুর্তে খোলা বাজারে এক মার্কিন ডলার বিনিময়ে ৯০.১০ টাকা পান একজন গ্রাহক।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারণ করে দেয়া হার হচ্ছে ৮৫.৭০ টাকা।
ডলারের সাথে সাথে অন্য প্রায় সব বৈদেশিক মুদ্রা যেমন পাউন্ড, ইউরো, সৌদি রিয়াল, কুয়েতি দিনার এবং ভারতীয় মুদ্রারও দাম বেড়েছে ব্যাংক ও খোলাবাজারে।
অথচ অগাস্টের শুরুতেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪.৮০ টাকা।
কিন্তু এ বছরের পাঁচই আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে।
ছবির উৎস, Getty Images
টিসিবির কম দামে পণ্য কিনতে ভিড় বাড়ছে
আছে অভ্যন্তরীণ সমস্যা
বেহাল পরিবহন ব্যবস্থা ও চাঁদাবাজির কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যগুলো বাজারে আসতে আসতেও দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারের একজন পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী বলছেন, "দেখুন আরিচায় ফেরি ডোবার পর থেকে বহু পণ্য বাহী ট্রাক ৪/৫দিন পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করেছে ঢাকায় আসার জন্য। একদিন দেরি হলেই যেখানে বাজারে প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে অবস্থা কেমন হতে পারে আপনারাই চিন্তা করে দেখুন।"
তিনি বলেন, কোন একটা জায়গায় মাছ, সবজি কিংবা এ ধরণের পণ্য যেগুলো বাংলাদেশের নানা জায়গায় উৎপাদন হয় সেখান থেকে আনার সময় কয়েক ধাপে চাঁদা দেয়ার সংস্কৃতি এখনো বন্ধ হয়নি।
আর এসব কিছু মিলেই আমদানি-নির্ভর কিংবা দেশে উৎপাদিত- উভয় ধরণের নিত্যপণ্যের দাম কেবল বাড়ছেই বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা বলছেন, একদিকে বৈশ্বিক সরবরাহ কম, আরেকদিকে দেশে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি- এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে অতি দরকারি পণ্যগুলোতে ভর্তুকি দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানো।