বাংলাদেশের ৫০ বছর: আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির আলোচনায় গণতন্ত্র ও উন্নয়ন

  • আবুল কালাম আজাদ
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
বাংলাদেশ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

৫০ বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়রকম ভাবমূর্তি হয়েছে।

পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যে পরিচিতি আর ভাবমূর্তি ছিল সেটি পাল্টেছে বহুভাবে। স্বাধীনতার ৫ দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ যেমন তৈরি হয়েছে আবার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ভাবমূর্তী এখনো দেখা যায়।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পনের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। লড়াই সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশটি শুরুতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে তকমা পায়।

বাংলাদেশ
ছবির ক্যাপশান,

৭০ এর দশকে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল দারিদ্র্য, দুর্যোগ আর রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ হিসেবে

৭০ এর দশকে স্বাধীন বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এক জনপদ হিসেবে চিনেছে বিশ্ববাসী। কিন্তু গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলোচিত হয়েছে। এখনো বাংলাদেশের সম্পর্কে আলোচনায় প্রাধান্য পায় ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় দিকই।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, "একটা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রশংসিত হয় বাংলাদেশ সেটা হলো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে। এছাড়া গণতন্ত্রের প্রশ্ন, অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশ্ন এবং ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত অবস্থানের প্রশ্ন এই তিনটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে।"

মি. রীয়াজ বলেন "কোনো দেশেরতো কেবল একটি মাত্র ভাবমূর্তি থাকে না। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন রকম সময়ে বিভিন্নভাবে তার ভাবমূর্তী গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে খুব স্পষ্ট আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয় তার একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি। এটা ক্রমাগত পিছনের দিকে যাত্রা করছে। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাফল্য।"

বাংলাদেশ

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টিও ইতিবাচক ভাবে দেখা হয় বহির্বিশ্বে

সময়ের পরিক্রমায় ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট আর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বদলেছে। আশির দশকেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইমেজ ছিল স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়া বিদেশি সাহায্য নির্ভর একটি দেশ হিসেবে। একটা বড় সময় ধরে দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় দেশ ছিল বাংলাদেশ। এই ভাবমূর্তি পরিবর্তন হতেও সময় লেগেছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের উন্নতি এব উজ্জল ভাবমূর্তী তুলে ধরতে বরাবরই একটা দুর্বলতা রয়েছে।

"প্রথম থেকেই বাংলাদেশকে দেখানো হতো অত্যন্ত দরিদ্র একটা দেশ। দেশের লোক খাবার পাচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যার ছবি। আশির দশকে নব্বই দশকের মধ্যেই আমরা আমাদের সামাজিক যে সমস্ত উন্নয়ন আছে সেই সূচকে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম।"

মিজ জাহান বলেন, "তখনো বাংলাদেশকে আগের মতোই ভাবমূর্তি ছিল। কিন্তু গত দশ পনের বছরে যখন বাংলাদেশে ক্রমাগত জিডিপি প্রৃবৃদ্ধি বাড়ছে সেটা এখণ সবার নজরে এসেছে।"

তার মতে, "এখন বাংলাদেশের ইমেজ হচ্ছে এটা হয় একটা ডেভলপমেন্ট মিরাকল আরেকটা কথা সবসময় তারা বলতে থাকে এটা হচ্ছে একটা ডেভলপমেন্ট প্যারাডক্স বা উন্নয়নের একটা ধাঁধাঁ।"

বাংলাদেশ
ছবির ক্যাপশান,

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রশংসিত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে

গত ৫ দশকে বাংলাদেশের যেসব অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেছে তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উঠে আসা, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণ ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। জঙ্গীবাদ দমনে সাফল্যের দিকটিও প্রশংসা পেয়েছে।

অন্যদিকে ভারতের সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জনের পরও সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে এ অঞ্চলে ভূ-রাজনীতিতে একটা নিজস্ব ভাবমূর্তি তৈরি করেছে বাংলাদেশ।

রওনক জাহানের মতে, "পররাষ্ট্রনীতি সেটা আমি বলবো সেটা বাংলাদেশ বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গেই গত কয়েকদশকে ভাল করছে। আমরা একসঙ্গে ভারত, চীন ওদিকে পাকিস্তান, জাপান এইযে নানার রকম চাপ এই সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এটা অনেকের নজরে এসেছে।"

আরো পড়তে পারেন:

আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তির সবচেয়ে বড় সংকট

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হলো গণতন্ত্রের প্রশ্নে।

রওনক জাহান বলেন, "বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে কয়েক বছর গণতন্ত্র আমাদের ছিল। আমরা একটা সংবিধান রচনা করে ফেললাম এবং '৭৩ এ একটা নির্বাচন হল। অর্থাৎ গণতন্ত্রই আমাদের অন্যতম ফাউন্ডিং প্রিন্সিপাল ছিল।"

"কিন্তু জানতে হবে যে ৭৫ এর পর থেকেই আমরা আর গণতন্ত্রের পথে হাটছি না। ৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম। ৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচন করে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। কিন্তু আবার দুই বছরের জন্য পড়ে গেলাম মিলিটারি ব্যাক গর্ভমেন্টের আন্ডারে।"

মিজ জাহান, বলছেন, "তারপরে যদিও আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচন ফেরত আনলাম । কিন্তু ২০১৪ এর পর থেকে আমাদের সব দলের অংশগ্রহণে সেরকম নির্বাচন হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রথম থেকে আমাদের যে গণতন্ত্রের একটা স্টেবল সিস্টেম, গণতন্ত্র বলতে যে বোঝায় যে ক্ষমতার পালাবদল কীভাবে হবে সেটা সম্বন্ধে সবার ঐক্য থাকবে। সেটাতো আমরা করতে পারছি না।"

রওনক জাহানের ভাষায়, "গণতন্ত্রের ইমেজ কিছুদিন ভাল ছিল, কিছুদিন খারাপ ছিল। অন্য সূচকে যেমন অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নে ক্রমাগত একটা উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু গণতন্ত্র আমরা দেখছি উঠছে আবার নামছে।"

বাংলাদেশ
ছবির ক্যাপশান,

গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইমেজ সংকট নিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, "বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাটা গত এক দশকে ক্রমাগতভাবে এই যাত্রাটা পেছন দিকেই গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্যতা বলে বিবেচিত হচ্ছে না।"

"বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারগুলো সংকুচিত হয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের এখনকার যে পরিস্থিতি সেটাকে গণতন্ত্র থেকে কেবল পশ্চাতযাত্রাই হচ্ছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এটাকে স্বৈরতন্ত্রও বলছে।"

যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে নিমন্ত্রণ না পাওয়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের একটা বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়।।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলছিলেন বাংলাদেশকে কেন সম্মেলনের বাইরে রাখা হল।

বাংলাদেশ
ছবির ক্যাপশান,

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা আছে আন্তর্জাতিক মহলে

"যে তিনটি ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এগুলো হচ্ছে কতৃত্ববাদের বিরোধিতা করা, দুর্নীতির মোকাবেলা করা এবং তৃতীয় হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা। এই তিনটার কোনটাতেই বাংলাদেশের এখনকার অবস্থা ইতিবাচক নয়। সেই প্রেক্ষাপটেই যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তর মনে করেছে যে বাংলাদেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।"

বাংলাদেশ তার নানা অর্জন তুলে ধরে বহির্বিশ্বে উজ্জল ভাবমূর্তী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে সব সময়। ৫০ বছরে এসে দেখা যায় বাংলাদেশ অনেক নেতিবাচক ইমেজ কাটিয়েও উঠেছে।

কিন্তু গণতন্ত্র আর রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশের যে ইমেজ সংকট এখনো আছে সেটি থেকে বেরিয়ে আসাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।