‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৩৬৮টি বইয়ের স্বত্বাধিকারী কে?

  • ফারহানা পারভীন
  • বিবিসি বাংলা, ঢাকা
'মাসুদ রানা' সিরিজের একটি বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবির ক্যাপশান,

'মাসুদ রানা' সিরিজের একটি বইয়ের প্রচ্ছদ

বাংলাদেশের জনপ্রিয় পেপারব্যাক সিরিজ 'মাসুদ রানা'র ২৬০টি ও 'কুয়াশা'র ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে কপিরাইট অফিসের দেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেবা প্রকাশনীর প্রধান কাজী আনোয়ার হোসেনের করা রিট খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট।

এই বইগুলোর কপিরাইটের অর্থ পরিশোধকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই শেখ আবদুল হাকিম এবং সেবা প্রকাশনীর মধ্যে বিবাদ চলছে।

মি. হাকিম - যিনি এ বছর আগস্ট মাসে মারা গেছেন - বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, বিদেশী কাহিনি অবলম্বন করে এই বইগুলো তার লেখা হলেও লেখক হিসেবে নাম যেতো সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের । এ জন্য তাকে এককালীন পারিশ্রমিক দেয়া হলেও বইগুলোর পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশের সময় তাকে লেখকের স্বত্ব হিসেবে কোন অর্থ দেয়া হয়নি।

এ বিবাদ কপিরাইট অফিস থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তবে সবশেষ এ রায়ের পরেও এই বইগুলোর আসল স্বত্বাধিকারী কে হবেন - সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি।

আজ সোমবার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কপিরাইট অফিসের সিদ্ধান্তের ওপর এর আগে হাইকোর্টের দেয়া স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার করেন।

কপিরাইট অফিসের আদেশ কী ছিল?

মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের মালিকানাস্বত্ব দাবি করে ২০১০ সালে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলেন শেখ আবদুল হাকিম।

নয় বছরেও অভিযোগের কোনো সুরাহা না পাওয়ায় গত বছর ২৯ জুলাই কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।

তিন দফা শুনানি ও দু'পক্ষের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির আলোকে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় কপিরাইট অফিস।

আরো পড়ুন:

এর ভিত্তিতে ওই বইগুলোর লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের স্বত্ব পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। গত বছরের আগস্টে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন কাজী আনোয়ার হোসেন।

রিটের প্রাথমিক শুনানির পর গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে 'মাসুদ রানা' ও 'কুয়াশা' সিরিজের কিছু বইয়ের বিষয়ে কপিরাইট অফিসের দেয়া আদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য স্থগিত করেন।

আদালতের রায়ের বিষয়ে ভিন্ন মত আইনজীবীদের

রেজিস্টার অব কপিরাইটসের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

তিনি বলেন " রিট মামলাটা আদালত খারিজ করে দিয়েছে আজ। যার ফলশ্রুতিতে এটাই দাঁড়ালো যে কপিরাইট অফিসের আদেশটাই বহাল থাকলো। এখন কাজী আনোয়ার হোসেন আদেশ মানতে বাধ্য হবেন।"

ছবির ক্যাপশান,

লেখক হিসাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম প্রকাশিত হলেও, দুইজন লেখক দাবি করেছেন, এসব বই আসলে তারা লিখেছেন, যা মি. হোসেনের নামে প্রকাশিত হয়েছে

"আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এখন মাসুদ রানা এবং কুয়াশা সিরিজের বইগুলো জব্দ থাকবে।"

এদিকে সেবা প্রকাশনীর পক্ষের আইনজীবী হামিদুল মিসবাহ বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন তারা। তিনি বলেন, কপিরাইট রেজিস্টারের কোন আদেশ দেয়ার এখতিয়ার নেই।

"আমরা ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আদালতে গিয়েছিলাম ,আমরা সেটা পাইনি। এখন আমরা আপিল বিভাগে যাবো"- বলেন তিনি।

মি. মিসবাহ বলেন "বইয়ের মালিকানা নিয়ে কোন কথা হয়নি, কোর্টও কোন কথা বলেননি। বইগুলো জব্দ করার কথা বলা হয়নি। কপিরাইট রেজিস্টার যে আদেশটা দিয়েছিলেন সেটা আমরা অবৈধ ঘোষণা করার কথা বলেছিলাম কোর্ট সেটাকে অবৈধ ঘোষণা করেনি। আবার বৈধ ঘোষণাও করেনি"।

কত টাকা পাবেন লেখকরা

শেখ আবদুল হাকিমের কপিরাইট সংক্রান্ত উপদেষ্টা ওলোরা আফরিন বলেন, মি.হাকিমের পরিবারের সঙ্গে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন তারা ।

"কপিরাইট আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন এক লক্ষ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। সে হিসেবে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব বই মি. হাকিমের জীবিত অবস্থায় তার অনুমতি না নিয়ে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে - সেটার জন্য আলাদা মামলা করবে কিনা সেটা আলোচনা করা হবে মি. হাকিমের ওয়ারিশদের সঙ্গে" - বলেন ওলোরা আফরিন।

এদিকে আইনজীবী হামিদুল মিসবাহ বলেন, বইয়ের টাকা পেতে হলে মি. হাকিমকে আগে তিনিই যে বই এর স্বত্বাধিকারী সেটা জেলা আদালতে প্রমাণ করে আসতে হত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি মারা যাওয়াতে এখন সেই সুযোগটা থাকছে না।

মি. মিসবাহ বলেন - "তখন যদি মি. হাকিম জেলা আদালতে মামলা করতেন তাহলে তার মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরিরা সেই মামলা চালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা আর সম্ভব না। অর্থ দাবী করতে হলে আগে প্রমাণ করতে হবে তিনি এই বইয়ের লেখক এবং মালিক।"

ছবির ক্যাপশান,

পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে পেপারব্যাক সিরিজ 'মাসুদ রানা' প্রকাশিত হয়ে আসছে

"টাকা-পয়সার বিষয়ের জন্য উপযুক্ত আদালতে যেতে হবে। তার যেকোন ওয়ারিশ ইচ্ছা করলে মামলা করতে পারবে" - বলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

কেন নিজেদের বই আরেকজনের নামে লেখার অনুমতি

শেখ আবদুল হাকিম এ বছরের অগাস্ট মাসে মারা যান। তিনি ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ''আমি আর্থিক কারণে এসব বই তাকে (কাজী আনোয়ার হোসেন) নামে লেখার অনুমতি দিয়েছি। কারণ তখন আমার টাকার দরকার ছিল।''

''আর ইংরেজি কাহিনীর নকল করে বাংলা এসব বই আমার নামে ছাপা হোক, সেটাও আমি কখনো চাইনি। কাউকে এসব বলতেও খারাপ লাগতো, তাই মুখ বুজে থেকেছি। তবে অনেকেই বিষয়টি জানতো।''

''প্রথম দিকে একেকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিলে পাঁচশো টাকা পাওয়া যেতো। পরে সেটা দশ হাজার পর্যন্ত হয়। সুতরাং কপিরাইট নিয়ে ভাবিনি। "

"যতদিন তারা নিয়মিত টাকা দিয়ে গেছেন, ততদিন আমি আপত্তিও করিনি। কিন্তু যখন দেখছি যে, বই আবার ছাপা হচ্ছে, কিন্তু আমাকে কোন টাকা দেয়া হচ্ছে না, তখন আমি অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছি।''

সেবা প্রকাশনীতে ১৯৯২ সাল থেকে লিখতে শুরু করেন আরেকজন লেখক ইফতেখার আমিন।

তিনি দাবি করেছেন, মাসুদ রানা সিরিজে তার লেখা ৫৮টি বই কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে ছাপা হয়েছে। তবে আজ সোমবার আদালতে মি. আমিনের বিষয়ে কোন আলোচনা হয় নি বলে জানিয়েছেন দুই পক্ষের আইনজীবীরা।

ইফতেখার আমিন বলেন, ''স্বাধীনতার আগে থেকে সেবা প্রকাশনীতে এই প্র্যাকটিসটা চলে আসছিল। ফলে আমি শুধু সেখানে যোগ হয়েছি।"

"তখন আনোয়ার সাহেব বলতেন, তোমাদের নামে ছাপা হলে তো পাঁচশো কপির বেশি বিক্রি হবে না, আমার নামে ছাপা হলে দুই হাজার কপি বিক্রি হবে। তাই আমরা সেখানে স্বত্বও দাবি করতে যাইনি।''

''কিন্তু যখন দেখলাম আমাদের লেখা বই বারবার ছাপা হচ্ছে, কিন্তু তার কোন আর্থিক সুবিধা আমরা পাচ্ছি না, তখন আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলাম।''

পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে পেপারব্যাক সিরিজ 'মাসুদ রানা' প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত এই সিরিজের চারশোর বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে।

বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন: